পাঁচ কারণে পর্যটনে আগ্রহ কম এবার
মূল্যস্ফীতির চাপ
ডলারের অতিরিক্ত দাম
উড়োজাহাজের টিকিট চড়া
তীব্র গরম আবহাওয়া
পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি
ঈদ আর নববর্ষ মিলে এবার লম্বা ছুটি পাচ্ছেন মানুষ। দুই উৎসবের আনন্দে শহর থেকে গ্রামে ছুটছে একটি বড় অংশ। এর বাইরে ছুটিতে বেড়াতে যাচ্ছেন কেউ কেউ। দেশে-বিদেশে পর্যটন এলাকায় ছুটি কাটানো গত কয়েক বছর ধরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা মানুষ বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে এখন কাটছাঁট করছে। মূলত পাঁচটি কারণে আগের বছরের তুলনায় এবার বেড়ানোয় আগ্রহ কমেছে।
পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির চাপ দেশেও আছে। মানুষ নিত্যদিনের জীবনযাপনের খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে ভ্রমণের মতো বিলাসিতায় খরচের চিন্তা করতে পারছে না। ডলারের দাম বেশি। বেশি দামে, উড়োজাহাজের টিকিটের দাম চড়া; তাই বিদেশে বেড়াতে যেতে আগ্রহী কম। খরচের চাপ ছাড়াও দেশের আবহাওয়া বেড়ানোর অনুকূলে নেই, এখন প্রচণ্ড গরম। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিস্থিতি যুক্ত হয়ে এবার বেড়ানোয় আগ্রহ কমেছে মানুষের।
তালিকায় আরও আছে নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্ত হয়েছে মালদ্বীপ। এর বাইরে দুবাই ও ভিয়েতনামে এবার যান কেউ কেউ। নতুন গন্তব্য হিসেবে কেনিয়া, উজবেকিস্তান, জর্ডান, কিরগিজস্তানেও আগ্রহ আছে কারও কারও।
নিজের বেড়াতে যেতে না পারার কারণ বললেন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা রাফিউজ্জামান। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যান। খরচের চাপ সামলে এবার কোনোভাবেই ব্যবস্থা করতে পারেননি। ভ্রমণেও খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তাই পরের ঈদে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সভাপতি শিবলুল আজম কোরেশী প্রথম আলোকে বলেন, এবার সামগ্রিকভাবে গত বছরের তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা কম হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। মানুষের মন্দা ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে ডলারের দামের কারণে বিদেশে চড়া খরচ আর দেশে উষ্ণ আবহাওয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি পর্যটনে আগ্রহ কমার কারণ হতে পারে।
গতবছরও যেটুকু আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল, এবার তা নেই। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ভালো নেই। আর ভ্রমণ তো বিলাসী খাত। যারা বেড়াতে যাবেন, তাঁদের হাতে টাকা নেই। অনেকে চড়া দামে উড়োজাহাজ টিকিট কিনতে পারছেন না। তাই তাঁরা পর্যটকদের সাড়া কম পাচ্ছেন।টোয়াব সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম
প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে তিন থেকে চার লাখ মানুষ দেশের বাইরে বেড়াতে যায়। তবে এবার এটি আগের বছরের তুলনায় কমবে বলে মনে করে টোয়াবের সদস্য সংগঠনগুলো। তাদের তথ্যমতে, দেশ থেকে বেড়াতে যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য হচ্ছে ভারত। এ তালিকায় আরও আছে নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্ত হয়েছে মালদ্বীপ। এর বাইরে দুবাই ও ভিয়েতনামে এবার যান কেউ কেউ। নতুন গন্তব্য হিসেবে কেনিয়া, উজবেকিস্তান, জর্ডান, কিরগিজস্তানেও আগ্রহ আছে কারও কারও।
ট্রাভেল এজেন্ট কসমস হলিডেজের স্বত্বাধিকারী সাব্বির আহমেদ বলেন, গত বছরের তুলনায় কম বুকিং হয়েছে এবারের ঈদে।
উড়োজাহাজ টিকিট ব্যবসার সঙ্গে ২০ বছর ধরে যুক্ত আছেন এক্সপেরিয়র হলিডেজের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ ইমরান আলী। তিনি বলেন, বিদেশে যেতে অনেকেই আসছেন। তবে উড়োজাহাজ টিকিটের চড়া দাম শুনে কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছেন।
পর্যটন খাতে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত টোয়াব সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গতবছরও যেটুকু আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল, এবার তা নেই। মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ভালো নেই। আর ভ্রমণ তো বিলাসী খাত। যারা বেড়াতে যাবেন, তাঁদের হাতে টাকা নেই। অনেকে চড়া দামে উড়োজাহাজ টিকিট কিনতে পারছেন না। তাই তাঁরা পর্যটকদের সাড়া কম পাচ্ছেন।
দেশে বেড়ানোর জনপ্রিয় গন্তব্য হচ্ছে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কুয়াকাটা, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, সুন্দরবন ও সেন্ট মার্টিন। এর মধ্যে সুন্দরবন ও সেন্ট মার্টিন এ সময় পর্যটন মূলত বন্ধ থাকে। নববর্ষে পাহাড়ি উৎসবকে কেন্দ্র করে তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটকদের আগ্রহ থাকে প্রতিবছর। এবারের ঈদের ছুটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নববর্ষ। টোয়াবের সদস্যরা বলছে, পার্বত্য তিন জেলায় বেড়ানোয় তেমন আগ্রহ নেই এবার। এক বছর ধরেই বিদেশি পর্যটকেরা অনুমতি পাচ্ছেন না সেখানে। ছয় মাস ধরে বান্দরবানে বেড়ানোর ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আর এখন তো বান্দরবানের পরিস্থিতি অশান্ত। বান্দরবানে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত কেউ ভালো নেই। তাই এবার ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও সিলেট এলাকায় বেড়াতে যাবেন মানুষ। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন প্যাকেজ ছেড়েছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। হোটেল, রিসোর্টও দিয়েছে ছাড়।
তবে কক্সবাজারে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ পর্যটক বেড়াতে যেতে পারেন এবার। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এ পর্যটন গন্তব্যে সাড়ে পাঁচ শর বেশি হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট আছে। এসব হোটেলে ধারণক্ষমতা দুই লাখের বেশি। স্থানীয় হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস মালিক সমিতি বলছে, ঈদের পরদিন থেকে মূলত বুকিং হয়েছে। গত বছর ঈদের আগেই শতভাগ বুকিং হয়ে গিয়েছিল। এবার এখন পর্যন্ত তা হয়নি।
টুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রিসোর্টগুলোতে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তবে কক্সবাজার হোটেল-গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, রোববার পর্যন্ত ৩০ শতাংশ অগ্রিম বুকিং নিশ্চিত হয়েছে। আজকালের মধ্যে শতভাগ বুকিং হতে পারে বলে আশা করছেন তিনি।
টোয়াবের সদস্যরা বলছে, পার্বত্য তিন জেলায় বেড়ানোয় তেমন আগ্রহ নেই এবার। এক বছর ধরেই বিদেশি পর্যটকেরা অনুমতি পাচ্ছেন না সেখানে। ছয় মাস ধরে বান্দরবানে বেড়ানোর ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আর এখন তো বান্দরবানের পরিস্থিতি অশান্ত।
দেশের ১০৪টি পর্যটন এলাকায় নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে টুরিস্ট পুলিশ। প্রতি জেলায় পুলিশ সুপার তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন। টুরিস্ট পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আবু কালাম সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, দেশের ভেতরে মানুষ যত বেড়াতে যাবে, ততই অর্থনীতির জন্য ভালো। ঈদ ও পয়লা বৈশাখের লম্বা ছুটিতে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে বেড়াতে পারে, সে জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকাতেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, সাজেকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
টুরিস্ট পুলিশ সূত্র জানায়, কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও পতেঙ্গায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের সুগন্ধা, কলাতলী, লাবণী, ইনানি সমুদ্রসৈকতে ‘ইন্টারকম’ রাখা হয়েছে। কেউ জরুরি সহায়তা চাইলে ‘ইন্টারকম’ বাটনে চাপ দিলেই পুলিশ পৌঁছে যাবে। পার্বত্য এলাকায়ও টুরিস্ট পুলিশের নিরাপত্তা সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে।
দেশের ভেতরে মানুষ যত বেড়াতে যাবে, ততই অর্থনীতির জন্য ভালো। ঈদ ও পয়লা বৈশাখের লম্বা ছুটিতে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে বেড়াতে পারে, সে জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকাতেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, সাজেকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছেটুরিস্ট পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আবু কালাম সিদ্দিকী
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব তৌফিক রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মধ্যে এখন অনেকেই নিজেরা হোটেল বা রিসোর্ট বুকিং দিয়ে চলে যায়। তারা ট্রাভেল এজেন্সির কাছে আসে না। তবে এবার ছুটির সময়টা ভালো না। গরম আবহাওয়া, বান্দরবান পরিস্থিতি মিলে দেশে পর্যটক কমছে। বিদেশেও গত বছরের চেয়ে কম যাচ্ছে এবার।