দেশে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। তবুও প্রচণ্ড গরমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না বিভিন্ন স্থানের মানুষ। কারিগরি কারণে রাজধানী ঢাকায় এবং বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ঢাকার বাইরে কিছু এলাকায় লোডশেডিংয়ে ভুগছেন মানুষ।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, আগামী মে মাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ধরে ১৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। টানা প্রচণ্ড গরমের কারণে এপ্রিলেই চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে গত রাতে ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে গরম থাকছে বেশি। এ সময় সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এতে কখনো কখনো ঘাটতি থাকছে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
অবশ্য পরিস্থিতি গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ভালো। তখন ডলার-সংকটে পড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য সরকার পরিকল্পিত লোডশেডিং করেছিল।
এবার গরমের শুরুতে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে লোডশেডিং ঠেকানো যাবে বলে আশা করেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। ৬ এপ্রিল থেকে দিনে ৭৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ভারতের আদানি গ্রুপ। দেশের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা থেকে এখন পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বেশি। তবে নিজস্ব কয়লায় চালিত বড়পুকুরিয়ায় একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে আছে।
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তিন দিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরুর পর ইতিমধ্যে কেন্দ্রটি কয়েক দফায় বন্ধ হয়েছে। কারিগরি কারণে আশুগঞ্জ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট বন্ধ হয়ে আছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে জ্বালানির (গ্যাস, তেল, কয়লা, পানি) অভাবে উৎপাদন করা যাচ্ছে না দুই হাজার মেগাওয়াট। আর যান্ত্রিক ত্রুটি ও রক্ষণাবেক্ষণে থাকার কারণে উৎপাদন করা যাচ্ছে না ৩ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট।
সব বিতরণ সংস্থাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি। এরপর তা গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। ঢাকার বাইরে চারটি সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে ঢাকার বাইরে। গতকাল সোমবার দিনের বেলায় সর্বোচ্চ উৎপাদনের সময়েও সারা দেশে লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর আগে রাত একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত দেশে লোডশেডিং হয়েছে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
তবে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার প্রথম আলোকে বলেন, রামপালসহ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ আছে। সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে। চাহিদা মেটাতে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এখনো সর্বোচ্চ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা চলছে।
লোডশেডিংয়ে ময়মনসিংহের বেশির ভাগ এলাকার মানুষ ভুগছেন। পিডিবির ময়মনসিংহের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ময়মনসিংহের ছয় জেলায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ঘাটতি ৩০০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত।
সিলেট পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, ১৩ এপ্রিল থেকে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ কমে আসে। এতে বাধ্য হয়ে এলাকাভেদে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর মহাব্যবস্থাপক মো. আক্তারুজ্জামান লস্কর বলেন, সোমবার ঘাটতি ছিল ২০ মেগাওয়াট। বেলা বাড়ার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
সিলেটে লোডশেডিং বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন গ্যাস-বিদ্যুৎ গ্রাহক কল্যাণ পরিষদ।
নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, চাহিদার তিন ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই লোডশেডিংয়ের কোনো রুটিন মানা যাচ্ছে না।
গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ৫৫ শতাংশ তাদের অধীনে। গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে গ্রাম এলাকাতেও। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাটতি বেশি হচ্ছে। রাতেও হচ্ছে কিছু কিছু। সংস্থাটির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে। লোড ভাগাভাগি করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।
আরইবির তথ্য বলছে, গত রোববার তাদের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৯ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। একই সময়ে সরবরাহ করা হয়েছে ৭ হাজার ৭৬৬ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮৪ মেগাওয়াট। গত বছর একই দিনে আরইবি লোডশেডিং করেছে মাত্র ১৩৩ মেগাওয়াট। গত শনিবার সর্বোচ্চ দুই হাজার ২২৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে আরইবি। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে খুলনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এরপর বেশি লোডশেডিং হয়েছে রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলে। ঢাকা বিভাগে লোডশেডিং ছিল নামমাত্র। আর বরিশাল অঞ্চলে কোথাও তেমন লোডশেডিং করা হয়নি।
রাজধানী ঢাকাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদামতো সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন আধুনিকায়ন করা হয়নি। তাই এখন বাড়তি সরবরাহ নিতে পারছে না কোনো কোনো বিদ্যুৎ বিতরণ ট্রান্সফরমার। আকস্মিকভাবে ট্রিপ (বন্ধ হয়ে যাওয়া) করে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গতকাল ট্রান্সফরমার বিকল হওয়ায় ভোর থেকে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিলেন বনশ্রী এলাকার মানুষ। গ্রীষ্মে ডেসকোর সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এবার ১ হাজার ২৯১ মেগাওয়াট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এ সময় ডিপিডিসির স্বাভাবিক চাহিদা থাকার কথা ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ৮৬৫ মেগাওয়াট।
গরমের কারণে অনেকে নতুন করে এসি বসাচ্ছেন। এতে অনুমোদনের চেয়ে বেশি লোড ব্যবহার করছেন বিদ্যুৎ গ্রাহকেরা। ফলে গ্রাহকের লাইন চাপ নিতে না পারায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও তাই ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ না পেয়ে লোডশেডিংয়ের অভিযোগ করছেন গ্রাহকেরা। তবে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান ও ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির কাউসার আলী প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। লোডশেডিং করা হচ্ছে না। কিছু কারিগরি সমস্যা হচ্ছে। তবে কোনো গ্রাহক লোড বাড়ানোর আবেদন করলে তা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ডলার-সংকটে পড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ে গত বছর জুলাই থেকে পরিকল্পিতভাবে লোডশেডিং শুরু করে সরকার। শীত শুরুর পর ডিসেম্বরের দিকে এটি কমতে থাকে। তবে শীত চলার সময়েও গ্রামে কিছু লোডশেডিং করা হয়েছে। মার্চ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পরিস্থিতি মোটামুটি সহনীয় ছিল। এরপর তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। এখন যে দাবদাহ চলছে, তা বিদায় নিলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। তখন লোডশেডিং কমার আশা আছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার ও ভোক্তা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। তবুও গরমে কষ্ট পাচ্ছেন মানুষ।
ক্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দফায় দফায় দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। বিদ্যুতের ঘাটতি গ্রামে পাঠিয়ে দেন কর্তারা। সমতার ভিত্তিতে বণ্টন করলে এটা সহনীয় হতো। আর সমাজের সুবিধাভোগীরা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়লে এ খাতের সমস্যারও সমাধান হবে। এখন গরম থেকে স্বস্তি পেতে বিদ্যুৎ নয়, বৃষ্টির ভরসায় থাকতে হবে।