বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। এরই অংশ হিসেবে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ মিশন পাঠানোর সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে গতকাল রোববার ঢাকা ছেড়ে গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধিদল। ১৬ দিনের বাংলাদেশ সফরে ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পথে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে, তা জানতে বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। সরকারি ও বেসরকারি স্তরে ৭০টির মতো বৈঠক করেছেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। এসব প্রশ্নের মধ্যে ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশ, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ, নির্বাচন আয়োজনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়া, নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো মৌলিক কিছু বিষয়।
ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, রিকার্ডো শেলেরির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের দলটি শুধু নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেছে। এ ছাড়া সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সচিবের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল, বিদেশি মিশন, নাগরিক সমাজ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে একবার করে মতবিনিময় করেছে।
ইইউর প্রাক্-নির্বাচনী প্রতিনিধিদলটি মূলত এসেছিল এখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে। এ জন্য তারা নানা স্তরে ঘুরেফিরে কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে। বিশেষ করে একটি পূর্ণাঙ্গ মিশন এসে বাংলাদেশে নির্বাচনের কাজ পর্যবেক্ষণ করাটা কতটা অর্থবহ হবে, তা নিয়ে সুপারিশ তৈরির জন্য তাদের ব্রাসেলস থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ফলে নির্বাচন ঘিরে মৌলিক কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ মিশন এলে কীভাবে কাজ করবে, কোথায় তাদের দাপ্তরিক কাজ পরিচালিত হবে, প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে কি না, সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া যাবে কি না—সে বিষয়গুলো সম্পর্কেও তারা ঢাকায় কথা বলে গেছে। বাংলাদেশ সফরের সময় প্রতিনিধিদলটি ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে এক দিনের জন্য সিলেটে গিয়েছিল।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রসঙ্গ এলে স্বভাবতই প্রথম প্রশ্নটি ওঠে নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে কি না। প্রতিনিধিদলটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান যে বিপরীত মেরুতে, তা দুই দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধিদলটি জেনে গেছে। কারণ, আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজনে বদ্ধপরিকর। অপর দিকে বিএনপি স্পষ্ট করেই বলেছে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বিধায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এমন বিপরীতমুখী অবস্থানের সমাধান কোথায়, সেই প্রশ্ন নানা পর্যায়ে মতবিনিময়ের সময় তুলেছিল ইইউ প্রতিনিধিদলটি। তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় উপস্থিত নাগরিক সমাজের একাধিক প্রতিনিধি গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, এই প্রশ্নটি তাঁদের করা হয়েছিল। তাঁরা বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন আয়োজনের প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যেতে হলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
ইইউ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সফরকালে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেছেন। সে সময় তাঁরা নির্বাচনব্যবস্থা, নির্বাচনের সময় সহিংসতা, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, ভোটার তালিকা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে কীভাবে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়, তাঁরা সে উত্তর খুঁজেছেন।
ঢাকায় ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি প্রথম আলোকে বলেন, ইইউর জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলটি ঢাকা সফর করে গেছে। পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তাদের মতামত ইইউর জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেলের কাছে জমা দেবে। ওই মূল্যায়নের ভিত্তিতে বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ইইউ মিশন পাঠানো হবে কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বোরেল।