সড়ক পরিবহন আইনটি হয়েছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আর এই আইন হওয়ার চার বছরের বেশি সময় পর হলো বিধিমালা। আইনটি আগে হলেও ক্ষতিপূরণসহ বেশ কিছু বিষয়ের কোনো কার্যকারিতা ছিল না এর বিধিমালার অভাবে। তাই দেরিতে হলেও একটা বিধিমালা যে হয়েছে, তা নিয়ে পরিবহনসংশ্লিষ্ট সব পক্ষই মোটামুটি খুশি। তবে বিধিমালার নানা ধারা নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের অধিকারকর্মীরা আপত্তি জানিয়েছেন।
বিশেষ করে বিধিমালাটিতে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণের যেসব বিষয় আছে, তা নিয়েই অধিকারকর্মীদের আপত্তি। তাঁরা বলছেন, যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণের অর্থ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। এটা বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে করা হয়নি। আবার বিধি করার পরও তা কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়েও সন্দিহান অধিকারকর্মীরা। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, বিধিমালা করার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সাধারণ মানুষ ক্ষতি চাওয়ার অধিকার পেল। এর বাস্তবায়ন হলে উপকার সবাই পাবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ভুক্তভোগীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আর দুর্ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে ভুক্তভোগী তিন লাখ টাকা সহায়তা পাবেন। এসব বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বিধিমালা জারি করা হয়েছে। গত ২৭ ডিসেম্বর এই বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
বিধিমালা অনুযায়ী, চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে তিন লাখ টাকা। তবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে এক লাখ টাকা।
ক্ষতিপূরণের দাবিগুলো ১২ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান হবেন এর চেয়ারম্যান।
বিধিমালা অনুযায়ী, আর্থিক সহায়তা পাওয়ার জন্য ফরম অনুযায়ী দুর্ঘটনা ঘটার সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদন দাখিল করার তারিখ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বোর্ডের চেয়ারম্যান অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন। এই কমিটি ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন বোর্ডের কাছে দেবে।
প্রতিবেদন দাখিলের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাস্টি বোর্ড আবেদন মঞ্জুরপূর্বক আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর্থিক সহায়তার টাকা আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবে ‘প্রাপকের হিসাবে প্রদেয়’ চেকের মাধ্যমে দিতে হবে। এ ছাড়া বিধিমালায় বলা আছে, আর্থিক সহায়তার জন্য আর্থিক সহায়তা তহবিল থাকবে এবং এই তহবিলে মোটরযানমালিক প্রতিটি মোটরযানের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে বার্ষিক বা এককালীন চাঁদা দেবেন।
বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিধিমালার সবচেয়ে দুর্বল দিক। সেখানে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারের জন্য যে পাঁচ লাখ টাকা ধরা হয়েছে, তা বাস্তবতাবর্জিত। এরপরও কথা আছে। যে প্রক্রিয়ায় এই পাঁচ লাখ টাকা আদায়ের কথা বলা আছে, তা–ও জটিল।
ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো শাখা হবে কি না, বিধিমালায় এটি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। তাই এক জেলার বাসিন্দা অন্য জেলায় দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তার ক্ষতিপূরণের বিষয়ের সুরাহা জটিল হয়ে যাবে বলেই মনে করছেন সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় গিয়ে যখন দুর্ঘটনার শিকার হবেন, তখন কে তাঁকে চিনবে? অন্য জেলায় গিয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য দেনদরবার করতে যে ব্যয়, সেটাই বা বহন করবেন কীভাবে? যদি এমন হয়, কোনো নারী তাঁর স্বামী ও সন্তান উভয় হারিয়েছেন দুর্ঘটনায়, তাহলে একা তিনি ভিন্ন জেলায় গিয়ে এই অর্থের জন্য কত দিন তদবির করতে পারবেন?
ক্ষতিপূরণ নিয়ে এই যেসব প্রশ্ন উঠল, তার জবাব দিয়েছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি মনে করেন, নতুন বিধিমালা সাধারণ মানুষকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত একটি পথের সন্ধান দিয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোনো অধিকার ছিল না। এই বিধিমালায় তা নিশ্চিত করা হয়েছে। জীবনের মূল্য অর্থ দিয়ে পূরণ করা যায় না। তবে যেখানে আগে কোনো ব্যবস্থা ছিল না, এখন তা হলো। এটা একটি অর্জন। এখন এর সফল বাস্তবায়নে মানুষ সহায়তা পাবে।
এক জেলার মানুষের পক্ষে অন্য জেলায় গিয়ে ক্ষতিপূরণ চাওয়ার জটিলতা প্রসঙ্গে নুর মোহাম্মদ মজুমদারের বক্তব্য, ‘প্রয়োজনে ট্রাস্টি বোর্ডের শাখা বাড়ানো যাবে। এসব বিষয় নিশ্চয়ই প্রয়োজনের নিরিখে করা হবে।’
বিধিমালা হলেও এখনো সেখানে কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা আছে, বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ। তিনি উদাহরণ হিসেবে ‘দোষসূচক পয়েন্ট’–এর কথা উল্লেখ করেন।
বিধিমালা অনুসারে প্রত্যেক চালকের লাইসেন্সের জন্য ১২ ‘দোষসূচক পয়েন্ট’ থাকবে। সড়ক পরিবহনের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের কারণে এক বা দুটি পয়েন্ট কেটে নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। যদি একজন চালক সব পয়েন্ট হারান, তাহলে তাঁর লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
সাইফুন নেওয়াজ বলেন, লাইসেন্সটা এখনো পয়েন্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে তৈরি করা হয়নি। আবার পুলিশ কীভাবে সেই পয়েন্ট কাটবে, তা–ও পরিষ্কার করা হয়নি।
বিধিমালা হওয়ার পর প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চললেও তা নিয়ে এখনো নিজেদের বিশ্লেষণ শেষ করেননি বলে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সম্মানিত মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ আলোচনায় আইনের বিধিমালা নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সেগুলোর কতটুকু বাস্তবায়ন হলো, তা আমরা দেখছি।’
ক. চালক অসুস্থ হলে।
খ. কোনো কারণে চালক মোটরযান চালাতে অযোগ্য বা অক্ষম হলে।
গ. বেপরোয়া ও বিপজ্জনকভাবে মোটরযান চালালে।
ঘ. অনিরাপদ অবস্থায় মোটরযান চালালে।
ঙ. কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী মোটরযান থামাতে ব্যর্থ হলে।
চ. রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরযান চালালে।
ছ. হালনাগাদ ফিটনেস সার্টিফিকেট বা ক্ষেত্রবিশেষে রুট পারমিট ছাড়া মোটরযান চালালে।
জ. অনুমোদনযোগ্য গতিসীমা, ওজনসীমা বা আসনসংখ্যা অতিক্রম করে মোটরযান চালালে।
ঝ. ট্রাফিক সংকেত বা চিহ্ন অমান্য করে মোটরযান চালালে।
ঞ. ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওভারটেকিং করে মোটরযান চালালে।
ট. ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতীত কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ কিংবা যে মোটরযানের জন্য যে শ্রেণির লাইসেন্স প্রয়োজন, তা ব্যতীত মোটরযান চালালে।
ঠ. নির্ধারিত স্থান বা স্টপেজ ব্যতীত ভিন্ন স্থানে মোটরযান থামালে।
ড) সড়ক বা মহাসড়কে মোটরযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে।
ঢ. আইনবহির্ভূত কাজে মোটরযান ব্যবহার করলে।
ণ. সরকার বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময় জারিকৃত কোনো আদেশ, পরিপত্র বা নীতিমালা লঙ্ঘন করলে।
(সূত্র: বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইনের বিধিমালা)