প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com
২০২১ সাল। কোরবানির ঈদের আগের রাত। সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার মামুনের জন্যই আমার উল্টো কষ্ট হচ্ছিল। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘সরি স্যার, আজ ঈদের রাতে আপনাকে খবরটা জানাতে হচ্ছে... !’ কিন্তু তত দিনে স্বাদ-গন্ধহীন জীবনের পাঁচটি দিন কেটে গেছে। মনে ক্ষীণ আশা অবশ্য ছিল, হয়তো আগের তিনবারের মতো এবারও নেগেটিভ আসবে। নাহ, এ যে শতগুণ সংক্রামক ডেলটা! দুই-তিনটা মাস্ক পরে, ওপর দিকে মাইক্রোপোর মেরে মেরে চামড়া কালো করে ফেলেও শেষ রক্ষা হলো না।
ঈদের সকালে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। কদমগাছটায় কলি এসেছে। তারও ওপারে মা ডাহুকটি একটিমাত্র ছাও নিয়ে মহাগর্বে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে আবার লাপাত্তা। আমি মরে যাওয়ার আগেই কি ঝরে যাবে কদমকলি!
ছোটবেলায় শালিক হতে ইচ্ছা করত। কী সুন্দর জীবন! স্কুল নেই। পড়া নেই। বৃক্ষের কোটরে শালিক বাসা বাঁধলে অস্থির হতাম; কিন্তু শালিকের ছানা আর পাওয়া হতো না।
করোনা পজিটিভ হওয়ার পর দেখেছিলাম, নারকেলগাছের কোটরে শালিকের আনাগোনা। একদিন টের পেলাম শালিকছানার কিচিরমিচির। তাকিয়ে দেখি, ছানাটি কোটরের বাইরে পায়ে কিছু আটকে ঝুলে আছে, উঠতে পারছে না। মা-বাবা পাগলের মতো ওড়াউড়ি করছে। কিছুই করতে পারছে না। আমিও কিছু করতে পারছি না। ভাবলাম, মানুষ হয়েছি ঢের ভালো। বিপদে পড়লে মানুষ এগিয়ে আসে। করোনায় মানুষকে বাঁচাতে মানুষই তো এগিয়ে আসছেন। সাহস পেলাম।
দুই দিন আগেও প্রায় ২০০ রোগীর করোনা ইউনিটে রাউন্ড দিয়ে এলাম। নিশ্বাসের জন্য হাহাকার করা কত রোগীকে সাহস দিয়ে এলাম। তবে আমি কেন হেরে যাব? অষ্টম-নবম দিনগুলো তবু আতঙ্কে কেটেছে। এই বুঝি শ্বাসকষ্ট শুরু হলো! এই অসহ্য সুন্দর পৃথিবীতে ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরবে, অথচ আমি থাকব না!
ছোটবেলায় শালিক হতে ইচ্ছা করত। কী সুন্দর জীবন! স্কুল নেই। পড়া নেই। বৃক্ষের কোটরে শালিক বাসা বাঁধলে অস্থির হতাম; কিন্তু শালিকের ছানা আর পাওয়া হতো না।
আবার কি একসঙ্গে গোল হয়ে বসে আমরা গানের কলি খেলতে পারব? ছুটে যেতে পারব প্রিয় দিঘিটার কাছে? ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম!
জ্বর ছিল আট দিন। আল্লাহর ওপর ভরসা করে একেকটা দিন কাটিয়েছি। বিশেষজ্ঞরা আশ্বস্ত করেছেন। চিকিৎসক বলে অনেকে আবার ভয়ও ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আসলে কোভিড তো তখনো অচেনা। কেউ বলেছেন, এখনই ফ্যাভিপিরাভির খান। রেমডিসিভির শুরু করেন। অমুকটা খেলে ক্ষতি নেই...। কোনোটাই লাগেনি। হয়তো কোভিশিল্ডের দুই ডোজ যুদ্ধে জিতেছে। সুস্থ হয়ে গেলাম।
১৩তম দিনে একটু বের হয়েছিলাম। আহ্! এই অক্সিজেন আমার কিনতে হয়নি! প্রকৃতিতে দামের ক্রম হলো খাবার > পানি > বাতাস। অথচ বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্যতার বিচারে বাতাস > পানি > খাবার! যে বাতাস এত দরকারি, তা প্রতিদিন ফ্রি ব্যবহার করছি কত লিটার? কয়টা সিলিন্ডার? যত দূর জানি, এ দেশে তো বাতাসই সবচেয়ে দূষিত। সবচেয়ে অযত্নে লালিত।
এখন পর্যন্ত ভালো আছি। নির্ভয়ে বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারছি। প্রতিটি নিশ্বাস সযত্ন–সজ্ঞানে নিই! ভাবি, এর মূল্য কত!
আমি এখানকার ক্যানসার বিভাগের প্রধান। ঘরে বসে থাকলে চলবে না। তাই ১৫তম দিন থেকে অফিস শুরু করি। আমার বিভাগে আমি ছাড়া আর একমাত্র চিকিৎসক ছিলেন মহসীন। তিনি থাকায় করোনাকালে এক দিনের জন্যও সেবা বন্ধ থাকেনি। রোগীদের ক্যানসার তো আর অপেক্ষা মানবে না। আমরা রুমের জানালায় পলিথিন লাগিয়ে রোগী বাইরে রেখে আর প্রচণ্ড গরমে গায়ে অদ্ভুতদর্শন পোশাক পরে চিকিৎসার পরামর্শ দিচ্ছিলাম। ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত এক বয়স্ক মানুষের কথা মনে আছে। জানালার পলিথিনের ফাঁক দিয়ে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে হাঁপাতে থাকা সেই রোগীর বুকে স্টেথোস্কোপ লাগাই। তিনি আমার গ্লাভস পরা হাতটা ধরে স্বস্তির কান্না করেছিলেন। আমি তাঁর ছলছল চোখের জানালা দিয়ে মনের গহিনে ঢুঁ মেরে এসেছিলাম আর আমার পাওনা পেয়ে গিয়েছিলাম!
আমার বিভাগে আমি ছাড়া আর একমাত্র চিকিৎসক ছিলেন মহসীন। তিনি থাকায় করোনাকালে এক দিনের জন্যও সেবা বন্ধ থাকেনি। রোগীদের ক্যানসার তো আর অপেক্ষা মানবে না।
আশ্চর্যের, দুঃখের ও কাকতালীয় বিষয় হলো, ২০২২ সালের কোরবানির ঈদের নামাজের সময়টাও আমাকে ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছে। কারণ, দ্বিতীয়বারের মতো আমি করোনার ছোবলে পড়ি। সেবার তেমন বিচলিত হইনি। বিশেষ কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।
এখন পর্যন্ত ভালো আছি। নির্ভয়ে বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারছি। প্রতিটি নিশ্বাস সযত্ন–সজ্ঞানে নিই! ভাবি, এর মূল্য কত!