আমার বড় ভাই আর স্যার 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com

১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পুরকৌশল বিভাগে ভর্তি হই। গ্রাম থেকে এসেছি। হোস্টেলে সিট পেয়েছি। ক্লাস শুরু হওয়ার দুদিন আগে বিছানাপত্র নিয়ে বিকেলে পৌঁছালাম হোস্টেলে। গিয়ে জানতে পারলাম সিট প্রস্তুত হয়নি, পরদিন পাওয়া যাবে।

সবাই অপরিচিত। সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, ‘বাড়ি কোথায়’, ‘নাম কী’ ইত্যাদি‌। হঠাৎ এক বড় ভাই একটু দূর থেকে বাড়ির কথা শুনে কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘তোমার বাড়ি মানিকগঞ্জ? আমার বাড়িও। এসো আমার সঙ্গে।’ তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন চারতলায় তাঁর কক্ষে। রাতে ডাইনিংয়ে নিয়ে খাওয়ালেন। জানালেন, আগেই তিনি বাবুর্চিকে একজন অতিথির কথা বলে রেখেছিলেন। রাতে তিনি আমাকে তাঁর বিছানায় থাকতে দিলেন। তিনি অন্য বিছানা শেয়ার করে রাত কাটালেন।

পরদিন বিকেলে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন নিউমার্কেটে। পুরকৌশলে পড়তে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কোথায় কোথায় পাওয়া যায়, কীভাবে যেতে হবে, সব বুঝিয়ে দিলেন। ফেরার সময় মরণচাঁদের দোকানে নিয়ে দই-মিষ্টি খাওয়ালেন। বড় ভাইটির নাম মো. কাজিম উদ্দিন।

কাজিম ভাইয়ের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব ছিল প্রায় ৩০ মাইল। এর প্রায় তিন বছর পর কাজিম ভাই বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে এক রাত থেকেছিলেন। কাজিম ভাই ছিলেন একজন সত্যিকারের সাদামনের মানুষ। কাজিম ভাইকে আমি কোনো দিন ভুলতে পারব না।

২.

দুই সেমিস্টার পর রোজার মাসে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট বন্ধ হয়ে যাবে। ড্রয়িংয়ের শিক্ষক বাড়ির কাজ দিলেন—যার যার বাড়ির সাইট প্ল্যান করে আনতে হবে। বাড়ির সীমানা, কোথায় কোন ঘর, পুকুর, গাছ, রাস্তা সবকিছু দেখিয়ে বর্তমান অবস্থার একটি এবং ভবিষ্যতে আমি কী কী করব তার একটি—এই দুটি সাইট প্ল্যান সবাইকে করে আনতে বললেন।

ছুটির পর বাড়ি গিয়ে শুরু হলো বাড়ির সীমানার মাপজোখ। আমাদের বাড়িটি ছিল প্রায় দুই একর জায়গার ওপর। তিন দিকে ছিল আমাদের নিচু ফসলি জমি। সাইট প্ল্যানের নিয়ম অনুযায়ী, স্থাপনার চারদিকে কী কী আছে তা দেখাতে হবে বা লিখে দিতে হবে। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে আমাদের জমির পরেই ছিল ঢাকা–আরিচা মহাসড়ক।

প্রতিবেশী বন্ধুদের সহযোগিতায় মাপজোখের কাজ শেষ করে শুরু হলো ড্রয়িং শিটে প্রাথমিক কাজ। আমাদের বাড়িটি মহাসড়ক–সংলগ্ন হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুদিন পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আরিচা চলে আসে। আমাদের বাড়িটি লুট হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাটকাঠি আর বাঁশের বেড়া দিয়ে মাত্র দুটি ছাপরা তুলে আমরা বসবাস শুরু করেছিলাম। আমার ড্রয়িং শিটে ওই দুটি ছাপরার অবস্থান দেখিয়ে ড্রয়িং করেছিলাম।

প্রাথমিক কাজ শেষ হওয়ার পর নিজেই ভাবলাম, আমাদের এত বড় বাড়ি, এত বড় বড় গাছপালা, বাঁশঝাড়, পুকুর, এত বড় ভিটি, তার মধ্যে শুধু দুটি ছাপরা কেমন যেন লাগছিল। বাবাকে দেখাতে বাবা বললেন, ‘খুব সুন্দর হয়েছে। মনে রাখবে, সততার মূল্য ঈশ্বর দেন’। বাবার কথায় খুশি হয়ে চূড়ান্তভাবে সব ড্রয়িং শেষ করলাম।

ছুটি শেষে যথাসময়ে সব ড্রয়িং স্যারের কাছে জমা দিই। এক সপ্তাহ পর স্যার ড্রয়িং শিট ক্লাসে নিয়ে এলেন। স্যার একজন করে নাম ডাকছেন, সে উঠে গিয়ে ড্রয়িং শিট নিয়ে চলে আসছে। প্রায় শেষ হতে চলেছে, কিন্তু আমার নাম ডাকছেন না। মনের মধ্যে কেমন যেন করতে লাগল।

সবশেষে স্যার আমার নাম ডাকলেন, গুরুদাস। স্যার আমার নাম ডেকেই মাথাটি আলতোভাবে উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন। স্যারের চোখে আমার চোখ। হয়তো দুই বা তিন সেকেন্ড। ওই মুহূর্তে আমার মনে হলো, স্যারের চোখ থেকে আমার ভেতরে এমন কিছু প্রবেশ করছে, যা আমাকে ভালোলাগার এক অপার্থিব অনুভূতি দিচ্ছে।

সংবিৎ ফিরে পেলাম স্যারের পরবর্তী ডাকে, এসো। ড্রয়িং শিট নিয়ে এলাম। স্যার কিছুই বললেন না। শিটের নিচে দেখলাম এ–প্লাস দিয়েছেন। পরে এই সাবজেক্টে আমি কখনো দ্বিতীয় হইনি। চাকরিজীবনে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ড্রয়িংয়ের জটিল কাজগুলো আমাকেই করতে দিতেন।

স্যারের নাম মো. সাইজুদ্দিন আহমেদ। স্যারের নাম যেখানেই উচ্চারণ করি, আপনা–আপনিই মাথা নত হয়ে আসে। তিনি ছিলেন সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বন্ধুর মতো ছিল আমাদের সঙ্গে তাঁর আচরণ।

স্যার, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।