মৃত্যুর ঠিক ছয় দিন আগে নূর এ আলম তৈমুর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। সেখানে তাঁর কোলে সাড়ে সাত মাসের ‘সহস্র তীর্থ’র গলায় একটা ছাইরঙা মাফলার ঝোলানো। তৈমুর নাক ও কপাল দিয়ে ছুঁয়ে রেখেছেন সন্তানের মুখ। আর সন্তানও দুটি আঙুল দিয়ে বাবার গাল স্পর্শ করে রেখেছে। ছবিটি পোস্ট করে তৈমুর লিখেছেন ‘বাবার মাফলার পরে বড় হয়ে যাচ্ছে কে?’ তবে ছেলের বড় হওয়াটা আর উপভোগ করা হলো না তৈমুরের।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর খিলক্ষেতে রেললাইন ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় নিহত হন বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা তৈমুর। সেদিনই সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন হয় তাঁর। দাফনের সময় সহস্র তীর্থর হাত দিয়ে কবরে দেওয়ানো হয় একমুঠো মাটি।
এ বছরের ১০ এপ্রিল জন্ম হয় সহস্র তীর্থর। নিহত তৈমুরের স্ত্রী সৈয়দা মাসনুনা আজ বুধবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সন্তান জীবনে প্রথম মাটি স্পর্শ করল, তা–ও সেটা নিজের বাবার কবরের মাটি।’
গতকাল সকালে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সাড়ে সাত মাসের সন্তানকে কোলে নিয়ে খিলক্ষেত রেলক্রসিংয়ে ছুটে এসেছিলেন মাসনুনা। পুলিশ তাঁকে বলেছিল, তৈমুর কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। তবে পুলিশের এই কথা মানতে নারাজ মাসনুনা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী কানে হেডফোন ব্যবহার করায় শুনতে পাননি, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। বরং ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজনকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সেই বিবরণ দিয়েছেন।
গতকাল দুর্ঘটনার বিষয়ে বিমানবন্দর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এসআই সুনীল চন্দ্র সূত্রধর প্রথম আলোকে জানান, ‘সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে খিলক্ষেত রেলগেটসংলগ্ন রেললাইন পার হতে গিয়ে নূর–ই আলম ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময় তাঁর কানে হেডফোন লাগানো থাকায় তিনি ট্রেন আসার শব্দ পাননি।’
তৈমুরের স্ত্রী মাসনুনা প্রথম আলোকে বলেন ‘২০১৭ সালে আমাদের সংসার শুরু হয়। সংসারজীবনে আমি কখনো দেখিনি হেডফোন দিয়ে ওকে মোবাইলে গান শুনতে। মিটিং করতে খুব প্রয়োজন হলে সে এয়ার বাড ব্যবহার করত। দুর্ঘটনাস্থল থেকে খিলক্ষেত থানার একজন মোবাইল উদ্ধার করেছিলেন। আমাকে তখনই সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। নম্বর, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সব চেক করেছি তখনই। দুর্ঘটনার আগপর্যন্ত মঙ্গলবার কারও সঙ্গে ওর যোগাযোগ হয়নি। তাহলে কানেই বা ফোন থাকবে কেন রেললাইন অতিক্রমের সময়?’
তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ির বক্তব্যে হেডফোনের কথা থাকায় বুধবার আবার যোগাযোগ করা হয় পুলিশ ফাঁড়িতে। এসআই সুনীল চন্দ্র সূত্রধর এবং এএসআই সানু মং মারমা দুজনই প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছিলেন, ঘটনাস্থলে ট্রেন আসছে বলে তাঁরা তৈমুরকে সতর্ক করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন কানে হেড ফোন থাকায় শুনতে পায়নি।’
হেডফোনটি পাওয়া গিয়েছে কি না, জানতে চাইলে সুনীল চন্দ্র ধর বলেন ‘ট্রেনের সঙ্গে আঘাত লাগার পর হেডফোন ঘটনাস্থলে পাওয়ার কথা নয়।’
এদিকে নিহত তৈমুরের স্ত্রী মাসনুনা প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে স্বামীর মৃত্যু, অন্যদিকে এমন অসতর্কতার তথ্য এখন আরও বেশি যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে মাসনুনা দেখেন, তৈমুরের মরদেহ ঘটনাস্থলে রেললাইনের পাশে রাখা ছিল। কেউ হয়তো কাছের ফলের দোকান থেকে সাদা চটের একটি ব্যাগ এনে মরদেহের একাংশ ঢেকে দিয়েছিলেন। মাথার নিচ থেকে তখনো রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছিল। নিহত তৈমুরের সঙ্গে থাকা ল্যাপটপ, মানিব্যাগ, মুঠোফোন কোনো কিছুই খোয়া যায়নি। ল্যাপটপটি ভেঙে গিয়েছে বলে জানালেন মাসনুনা।
মাসনুনা বলেন, ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন বলেন, মধ্যবয়সী এক নারী রেললাইনের একদম কাছে চলে গিয়েছিল। তখন একদিক থেকে ট্রেন আসছিল। সেই নারীকে বাঁচাতে ছুটে যান তৈমুর। সেই নারী রক্ষা পেলেও বিপরীত দিক থেকে আসা অপর ট্রেনে কাটা পড়েন তৈমুর।
বুধবার দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয় নিহত তৈমুরের মা তাসলিমা খাতুনের সঙ্গে। তখন তিনি মাত্র জোহরের নামাজ পড়ে উঠলেন। সদ্য সন্তান হারানো এই মা প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৈমুর আমার প্রথম সন্তান। আমার এই ছেলে ছোটবেলা থেকেই মানুষের বিপদ দেখলে ছুটে যায়। ও পথের পশু-পাখিকে ভাত মেখে খাওয়াত। সবকিছুর জন্য ওর এত মায়া! আমার সেই সন্তান এখন কবরে শুয়ে আছে। যে কবরে আমার থাকার কথা, সেই কবরে এখন আমার সন্তান।’
তৈমুরের বাবা মো. মাজহারুল ইসলাম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান দুই বছর আগে। সিরাজগঞ্জে কাজীপাড়ায় পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর পাশেই দাফন করা হয়েছে তৈমুরকে।
এ মাসে সন্তানের সাত মাসের জন্মদিন পালন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈমুর লিখেছিলেন, ‘এখন তোমার সাত মাস বয়স, তুমিই আমাদের স্বর্গ’। তৈমুরকে যেন আল্লাহ স্বর্গ বা বেহেশতে ঠাঁই দেন, বুধবার দুপুরে নামাজ শেষে এই দোয়াই করছিলেন মা তাসলিমা।