মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতির ভিত্তি। গত ২৫ বছরে প্রথম আলো বিচিত্র বিষয়ে ও মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছে। উদ্ধার করেছে দেশি–বিদেশি অজানা তথ্য ও দলিল, সংগ্রহ করেছে ঘটনার নায়ক থেকে সাধারণ মানুষদের অভিজ্ঞতা, প্রকাশ করেছে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচয়, ছাপিয়েছে কুশীলব ও গবেষকদের লেখা। প্রথম আলোর মহাফেজখানা থেকে থাকল বাছাই লেখা।
মূ ল র চ না
শুনেছি, বিপ্লবের পরে নাকি প্রতিবিপ্লব ঘটে। কিন্তু বিজয়ের পরে যে বিপর্যয় আসে, সে তো নিজের চোখেই দেখলাম। কত রক্ত, কত আত্মত্যাগের বদলে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো! সে তো কেবল এক দিনে নয়। চব্বিশ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম আমাদের ধীরে ধীরে প্রস্তুত করেছিল বিজয়ের এই ক্ষণটির জন্যে। পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর আক্রমণ সেই সংগ্রামের শেষ অধ্যায় রচনা করেছিল বিদ্যুৎগতিতে। আজ তো মুছেই দেওয়া হচ্ছে চব্বিশ বছরের সংগ্রামের সেই ইতিহাস। মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটা সামরিক সংঘাতের বিষয়। ভ্রাতৃপ্রতিম পাকিস্তানি সেনাদের স্বদেশে পাঠিয়ে দিয়ে এই ভূখণ্ডের কর্তৃত্ব দখল করাই ছিল বুঝি এর একমাত্র উদ্দেশ্য।
ওই চব্বিশ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসকে অপ্রাসঙ্গিক করে না ফেললে ১৯৭২ সালের সংবিধানে গৃহীত রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিগুলো নষ্ট করা যেত না। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আবার কী, ধর্মনিরপেক্ষতা তো ভারতীয় ধারণা, সমাজতন্ত্র তো রুশ প্রতীতি—ওসব আবার কেন? গণতন্ত্র চাই বটে, কিন্তু তাও কি যখন-তখন? গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যেই তো জারি হয় সামরিক শাসন—একবার ফিরিয়ে যদি দেখা যায় জনসাধারণ উপযুক্ত হয়নি গণতন্ত্রলাভের, তবে আবার দিতে হয় সামরিক শাসন। যাঁরা সামরিক শাসন জারি করেন, তাঁদের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার। যত শীঘ্রসম্ভব তাঁরা ফিরে যেতে চান নিজের কাজে-শুধু আমজনতার মঙ্গলের জন্যে তৈরি করেন একটি রাজনৈতিক দল, জনগণের ইচ্ছা পূরণ করতেই কেবল রয়ে যান শাসনক্ষমতায়। তাঁরা যখন আবিভূর্ত হন, জনসাধারণ হাততালি দিয়ে অভ্যর্থনা জানায় তাঁদের, রাজনীতিবিদদের একটা অংশ দৌড়ে গিয়ে অভিনন্দন জানায়-খুদকুঁড়ো কিছু পাওয়ার আশায়। তারপর একদিন অতিষ্ঠ মানুষ অনেক রক্ত ঝরিয়ে উচ্ছেদ করে শাসকদের। অথবা শাসকদের নিজেদের দ্বন্দ্বে রক্ত ঝরে আরও, ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। আবার মানুষের উত্থান, আবার গণতন্ত্রের ফিরে আসা।
কিন্তু সামরিক শাসকেরা ওই যে একটা ভূমিকার আদর্শ রেখে যান, সেটার চাকচিক্য বুঝি চোখ ধাঁধিয়ে দেয় গণতান্ত্রিক নেতাদের। তাঁরা যে-পদ্ধতি চালান, তাতে জবাবদিহিতার অনিবার্য বাধ্যতা থাকে—দলের কাছে, সংসদের কাছে, জনসাধারণের কাছে। অথচ সামরিক শাসকেরা কেমন বাধাবন্ধহীন, তাঁদের কাছেই জবাবদিহি করতে হয় সকলকে। সেই যে এক কবি লিখেছিলেন—বাজারে ঢ্যাঁটরা পিটিয়ে বলা হয়েছে কথা শুনতে, নইলে জনসাধারণকেই পাল্টে দেওয়া হবে—অনেকটা সেই রকম। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোথায় সে সুযোগ? গণতন্ত্রী হয়েও তাঁদের ভালো লাগে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে। দল চলে তাঁদেরই ইচ্ছায়—দলীয় নেতা ও কর্মীদের ভাগ্যও তাঁদের হাতের মুঠোয়। কারও পছন্দ সংসদে বসে তর্ক করা, কেউ হয়তো সংসদ সম্পর্কেই উদাসীন। তবে সকলে মিলে সংসদ অকার্যকর করে তোলা যায় অতি সহজে। নির্বাচিত হয়ে গেলে সব সাংসদ আবার সাধারণের ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকেন না, অন্য পক্ষে জনসাধারণের সব কথা সময়মতো কানে এসে পৌঁছায় না নেতাদের। মধ্যস্থ আছেন অনেক মন্ত্রী ও সান্ত্রী, পাতিনেতা ও কর্মী, আমলা ও কামলা। তাঁরা ক্রমাগত বলতে থাকেন, সব ঠিক আছে, জনসাধারণ তো এটাই চায়, আরও বেশি করে চায় আপনাকে।
যদি কেউ বলতে চান, আমার দায়িত্ব তো শুধু দলীয় কর্মীদের প্রতি নয়, সকলের প্রতি, তাহলে তিনি নিজের বিপদ ডেকে আনবেন। কর্মীরা বলবে, তাহলে থাকুন আপনি সকলকে নিয়ে, আমরা চললাম, সামনের ইলেকশনে দেখা যাবে আপনি কী করেন?
এরই মধ্যে দুর্নীতি রয়ে যায়—সমাজে, রাজনীতিতে, রাষ্ট্রব্যবস্থায়। ও-জিনিস একবার ঘরে ঢুকলে বেরোয় না। এ-সম্পর্কে একধরনের সহনশীলতা গড়ে ওঠে। আহা, বেচারারা বহুদিন খেতে পায়নি, এখন একটু খেয়ে নিক। আরেক রোগে আক্রান্ত হয় রাজনীতি—তার নাম প্রতিহিংসা। সবকিছু থেকে দূর করে দিতে হবে অপরপক্ষকে—ওদের প্রতি সামান্যতম আনুগত্য আছে বলে সন্দেহ করা যায় যাকে, তাকেও যেনতেনপ্রকারে বিদায় দেওয়া চাই। প্রতিপক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া চাই যাতে তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। শারীরিক আক্রমণ থেকে চলাফেরার স্বাধীনতাহরণ, মিথ্যা মামলা থেকে বাড়িঘর ভেঙে দেওয়া, গ্রেপ্তার করে ধোলাই দেওয়া থেকে অভিযোগ ছাড়াই জেলে পাঠানো—সবই সিদ্ধ এ ক্ষেত্রে।
দলের পাতিনেতা ও কর্মীদের দাবি, যা-কিছু সুযোগ-সুবিধা আমাদেরকেই দিতে হবে, নইলে আমরা দল করি কেন? পাঁচ বছরের জন্যে আমাদের হাতে রাষ্ট্র তুলে দিয়েছে জনগণ—আমাদের যা-ইচ্ছে তা–ই করার স্বাধীনতা দিয়েছে। আমরা তা–ই করব, কে বাধা দেবে আমাদের, আমরা কি ডরাই কাউকে?
যদি কেউ বলতে চান, আমার দায়িত্ব তো শুধু দলীয় কর্মীদের প্রতি নয়, সকলের প্রতি, তাহলে তিনি নিজের বিপদ ডেকে আনবেন। কর্মীরা বলবে, তাহলে থাকুন আপনি সকলকে নিয়ে, আমরা চললাম, সামনের ইলেকশনে দেখা যাবে আপনি কী করেন?
এদিকে দুর্বৃত্তায়ন হয় রাজনীতির। ওদের দশজন সন্ত্রাসী আছে, আমাদের চাই ১৫ জন। দুবৃর্ত্তরাও সময় বুঝে ভোল পাল্টায়-আজ এ-দলে তো কাল ও-দলে। সন্ত্রাস করা ছাড়া তারা চায় রাজনৈতিক প্রশ্রয়, প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য। তাদের কার্যকলাপ একসময় সীমা ছাড়িয়ে যায়, সন্ত্রাস অসহনীয় সঙ্গী হয়ে ওঠে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের। অসামরিক প্রশাসন কিছু করে না—দুর্নীতির বশ তারা, ক্ষমতাসীনদের দাপটে ভয় করে কিংবা তাদের প্রভাবে চলতে হয়।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে চায়। তখন এমন কিছু করতে হয়, যা সেই ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নবনিযুক্তরা তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের হেফাজতে মানুষ নিগৃহীত হয়, জীবন হারায়।
যারা বেঁচে থাকে, তারা ভাবে, আমরা কি এই দেশ চেয়েছিলাম? যারা সাম্প্রদায়িকতার বা বৈষম্যের শিকার হয়, তারা ভাবে, এমন তো কথা ছিল না। যারা সন্ত্রাসীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তারা ভাবে, এ কেমন স্বাধীনতা?
বিজয় আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে—তারপরও আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, এমন বিপর্যয় কেন?
প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর ২০০২