জাল দলিল চক্রের সঙ্গে দুজন সাবরেজিস্ট্রার, পুলিশ, দলিল লেখক ও স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মীর জড়িত থাকার অভিযোগ।
নীলফামারীর ডিমলার রূপাহারা গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমানের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িভিটাসহ ৭০ শতাংশ জমি বেদখল হয় তিন বছর আগে। ওই জমির মালিকানা দাবি করেন স্থানীয় বাসিন্দা রণজিৎ চন্দ্র ভূঁইমালী, হাফিজুল ইসলাম ও ময়েন কবীর। তাঁদের সহযোগী মশিদুল রাতারাতি ওই জমিতে ঘর তোলেন।
শুধু তা–ই নয়, নীলফামারীর আমলি জজ আদালতে হাফিজুরকে জমির অবৈধ দখলদার উল্লেখ করে মামলা দেন রণজিৎ। পরে হাফিজুর উপজেলা ভূমি কার্যালয় ও রংপুর জেলা মহাফেজখানা কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জানেন, মিথ্যা দলিল ও নামজারি দিয়ে তাঁর জমি দখল ও বিক্রি করা হয়েছে।
জাল দলিল চক্রের খপ্পরে মানুষ জমি হারাচ্ছেন। এ ঘটনার সঙ্গে সাবরেজিস্ট্রার বা ওসি—যাঁরাই জড়িত থাকুক না কেন, তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার। কিন্তু তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।আবদুল মজিদ, সভাপতি, সুজন, নীলফামারী
হাফিজুর প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দিনমজুরি করে সংসার চালান। থানায় গিয়েছিলেন প্রতিকার পেতে। কিন্তু সহযোগিতা পাননি। দখলদারেরা তাঁকে হত্যাচেষ্টার মামলার আসামি করেছে। দুই মামলা সামলাতে তাঁর অন্তত দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।
হাফিজুরের এ ঘটনা একটি উদাহরণমাত্র। ডিমলার স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, গত পাঁচ–ছয় বছরে উপজেলায় জাল দলিলের এক চক্র সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলার ১০ ইউনিয়নের চার শতাধিক বাসিন্দা ২৫-৩০ জনের এ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চক্রের মূলে রয়েছেন ময়েন কবীর, হাফিজুল ইসলাম, রণজিৎ চন্দ্র ভূঁইমালী, মাজেদুল ইসলাম ও প্রদীপ কুমার। ময়েন কবীর একটি দৈনিক পত্রিকার ডিমলা উপজেলা প্রতিনিধি। প্রদীপ রেজিস্ট্রারভুক্ত দলিল লেখক। হাফিজুল ও মাজেদুল সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের ‘দালাল’।
স্থানীয় লোকের ভাষ্য, চক্রটির সঙ্গে ডিমলার সাবেক ও বর্তমান সাবরেজিস্ট্রার, থানার সাবেক ওসি, পাঁচ–ছয়জন দলিল লেখক ও একজন আইনজীবী জড়িত। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতার যোগসাজশ রয়েছে তাঁদের সঙ্গে।
এই জালিয়াত চক্রের ১৪ জনকে পুলিশ গত দুই মাসে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে আটজন জামিনে বের হয়ে আবারও জমি জালিয়াতি তৎপরতায় যুক্ত হয়েছেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে ডিমলা সদর ইউনিয়নের বাবুরহাটে শিক্ষক মশিয়ার রহমানের ১৫ শতাংশ জমি দখল করেন ময়েন, হাফিজুল ও রণজিৎ চক্র। মশিয়ার বলেন, তাঁর জমি দখল হলে চক্রটির দাবি করা দলিলটির সঠিকতা যাচাইয়ে তিনি রংপুর জেলা সাবরেজিস্ট্রার কার্যালয়ের মহাফেজখানায় খোঁজ নেন। সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন, ওই নম্বরের কোনো দলিল নেই। তখন তিনি দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, চক্রটির সদস্যরা পুরোনো দলিল সংগ্রহ করে কাগজের লেখা বা চিহ্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তুলে জাল দলিল সম্পাদন করেন। তাঁদের কাছে ব্রিটিশ–পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মূল্যমানের দলিল তৈরির স্ট্যাম্পসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে।
গত ১১ নভেম্বর এ জাল চক্রের সদস্য মাজেদুল ও রফিকুল ইসলামকে শতাধিক স্ট্যাম্প, জালিয়াতির অন্যান্য উপকরণসহ গ্রেপ্তার করে ডিমলা থানা–পুলিশ। এ ছাড়া গত ৮ ডিসেম্বর একটি চাঁদাবাজির মামলায় জেলা জজ আদালতে হাজিরা দিতে গেলে রণজিৎকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। তবে রণজিৎ ১৪ দিন পর জামিনে বের হন।
উপজেলার বাইশপুকুর গ্রামের বাসিন্দা জহুরুল ইসলামের গল্পটা অন্য রকম। তিনি ছয় বছর আগে মোহর আলী নামে একজনের কাছ থেকে জমি কেনেন। কিন্তু ২০২১ সালে নুর হক নামের স্থানীয় একজন বাসিন্দা ওই জমির মালিকানা দাবি করে দখল করে নেন। তখন (জুন ২০২২) জহুরুল ৬ লাখ টাকা দিয়ে একই জমি নুর হকের কাছ থেকে দ্বিতীয়বার কিনতে বাধ্য হন।
আদালত সূত্র জানায়, জহুরুল একপর্যায়ে নিজেকে প্রতারিত মনে করে মোহরের বিরুদ্ধে নীলফামারীর আমলি আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ডিমলা থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়।
পুলিশি তদন্তে দেখা যায়, মোহর আলীই ওই জমির প্রকৃত মালিক ছিলেন। তাঁর নামে হাল রেকর্ডও (সর্বশেষ খতিয়ান) হয়েছিল। তখন নীলফামারী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. মেহেদী হাসান তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রার রামজীবন কুণ্ডুসহ জাল দলিলের সঙ্গে জড়িত চারজনের নামে মামলার নির্দেশ দেন। পুলিশ তখন রামজীবন বাদে নুর হক, দলিল লেখক প্রদীপসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে এই চারজন জামিনে বের হন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, সাবেক সাবরেজিস্ট্রার রামজীবনের সময় ডিমলায় জালিয়াতির মাধ্যমে জমি রেজিস্ট্রির হিড়িক পড়ে। রামজীবন ২০১৯–এর ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১–এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিমলার সাবরেজিস্ট্রার ছিলেন। ২০২০ সালে ৮ হাজার ৬০০ এবং ২০২১ সালে ৯ হাজার ১০০টি দলিল সম্পাদন হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, রামজীবনের আগে উপজেলায় বছরে গড়ে ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার জমি রেজিস্ট্রি হতো।
রামজীবন এখন রংপুর সদর উপজেলার সাবরেজিস্ট্রার। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রামজীবন কুণ্ডু দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য নয়। মামলার বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, বিষয়টির তদন্ত চলছে।
বাবুরহাটের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলমকেও একই জমি দুবার কিনতে হয়েছে। প্রতারক চক্রটি তাঁর ক্রয় করা জমির মালিকানা দাবি করলে ঝামেলা এড়াতে তিনি দ্বিতীয় দফায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রি করে নেন। সাবরেজিস্ট্রার রামজীবন কুণ্ডু জমি রেজিস্ট্রি করেন রাতে চক্রের সদস্য হাফিজুলের বাসায়।
জাহাঙ্গীর আলমের অভিযোগ প্রসঙ্গে রামজীবন বলেন, তাঁর এমন কিছু মনে পড়ছে না।
জাল দলিল ও জাল নামজারি দিয়ে বাবুরহাটের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদের ১০ শতাংশ জমি বিক্রি করেন রণজিৎ ভূঁইমালী, গত বছরের ১২ জানুয়ারি। জমি রেজিস্ট্রির নিয়ম অনুযায়ী, জমির দখল, দলিল, নামজারি ও বিএস রেকর্ড যাচাই করে জমির নতুন রেজিস্ট্রি করতে হয়।
হারুন অর রশিদের অভিযোগ, তিনি বর্তমান সাবরেজিস্ট্রার মনীষা রানীকে তাঁর জমির মূল কাগজপত্র দেখিয়ে রেজিস্ট্রি বন্ধের আবেদন করেন। বিষয়টি তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকেও (ইউএনও) লিখিতভাবে জানান। কিন্তু সাবরেজিস্ট্রার মনীষা চক্রের সদস্য রণজিতের জাল দলিল ও নামজারি দিয়ে সফিয়ার রহমানের নামে জমি রেজিস্ট্রি করে দেন।
সাবরেজিস্ট্রার মনীষা রানী তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। গত ৮ ডিসেম্বর তাঁর কার্যালয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়।
তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগের বিষয়টি জানতে পেরে তিনি সাবরেজিস্ট্রারকে কাগজপত্র খতিয়ে দেখার সুপারিশ করেছিলেন। এর বেশি কিছু করার এখতিয়ার তাঁর নেই।
ডিমলার পাঁচটি গ্রামের অন্তত ২৫ জন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেছেন, সাবরেজিস্ট্রার মনীষার দায়িত্ব পালনকালে গত ১০ থেকে ১১ মাসে জাল দলিল ও জাল নামজারি দিয়ে তাঁদের জমি বিক্রি করেছে জালিয়াত চক্র।
ডিমলা থানার পাশে শিবমন্দির ও ব্র্যাক মোড়ের অন্তত ১২ জন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ভুয়া জাল দলিল চক্রের বিরুদ্ধে থানায় গেলে ওসি সিরাজুল ইসলাম উল্টো তাঁদের হয়রানি করেন। তাঁদের দাবি, এ চক্রের সদস্য গণমাধ্যমকর্মী ময়েন কবীরের সঙ্গে ওসির সখ্য ছিল। ওসি সিরাজুলের প্রশ্রয়ে এই চক্র বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
সিরাজুল ২০২০–এর ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২–এর ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ডিমলা থানার ওসি ছিলেন। গত ৩০ মার্চ এক ব্যবসায়ীকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় আন্দোলনের মুখে তাঁকে বদলি করা হয়। তিনি এখন পঞ্চগড়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক।
ময়েন কবীর অবশ্য দাবি করেন, জমি নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেকের ঝামেলা রয়েছে। তবে তিনি জমি দখলের সঙ্গে জড়িত নন।
শিবমন্দির এলাকার জহুরা বেগমের অভিযোগ, জাল দলিল দেখিয়ে ওসি সিরাজুল পুলিশ দিয়ে তাঁদের উচ্ছেদের চেষ্টা করেন। প্রতিবাদ করলে তাঁর ছেলে শাহীনুর ও ছেলের বউ নাজমিরাকে থানায় নিয়ে যান।
জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম দাবি করেন, এসব ঘটনার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা নেই।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওসির সম্পৃক্ততার বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা কমিটির সভাপতি আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, জাল দলিল চক্রের খপ্পরে মানুষ জমি হারাচ্ছেন। এ ঘটনার সঙ্গে সাবরেজিস্ট্রার বা ওসি—যাঁরাই জড়িত থাকুক না কেন, তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার। কিন্তু তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।