বিশ্লেষণ

আজিজের ভাইদের এনআইডি: এক পা এগোতে ইসির কেন তিন বছর লাগল

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের দুই ভাই যে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তা সবাই জানত। প্রথম আলোতে বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।

সেই ঘটনা নিয়ে অর্থাৎ আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফের মিথ্যা পরিচয়ে এনআইডি নেওয়ার বিষয়টি তদন্তে গত রোববার কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মাধ্যমে জালিয়াতি তদন্তে কমিশন এক পা এগোল।

বিস্ময়কর হলো, এক পা ফেলতে তাদের লাগল প্রায় তিন বছর চার মাস। এই গতিকে কি কচ্ছপের গতি বলা যায়, নাকি শামুকের গতি বললে ঠিক হবে। নতুন একটি বাগ্‌ধারাও তৈরি করা যেতে পারে। তা হবে ‘নির্বাচন কমিশনের গতি’। এই বাগ্‌ধারার মাধ্যমে বোঝাবে যে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একটি পদক্ষেপ নিতে তিন বছরের বেশি সময় লাগিয়ে দেয়।

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ

২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আজিজ আহমেদের ভাইদের নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট’। প্রথম পাতায় তিন কলামে দুই ভাইয়ের ছবিসহ প্রতিবেদনটি নিশ্চয়ই তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নূরুল হুদা ও অন্য কমিশনারদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। কমিশনের নিশ্চয়ই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁদের কাজ কমিশন নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন কমিশনারদের কাছে তুলে ধরা। তার পরও ধরে নিলাম তাঁদের চোখ এড়িয়ে গেছে। কিন্তু প্রথম আলো তো কমিশনের বক্তব্য নিয়েছিল।

আসল বিষয় হলো, সবাই সবকিছু জানতেন। পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, সরকারের কাছ থেকে সবুজসংকেত না পেয়ে চুপ ছিলেন তাঁরা।

যা-ই হোক, নূরুল হুদা কমিশন বিদায় নেওয়ার পর ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব নেয় কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। তারাও দুই বছরের বেশি সময় চুপ ছিল, প্যান্ডোরার বাক্স খুলতে চায়নি। গ্রিক পুরাণমতে, পৃথিবীর প্রথম নারী প্যান্ডোরাকে একটি বাক্স উপহার দিয়েছিলেন দেবতারা। তবে বাক্সটি খুলতে নিষেধ করেছিলেন। উৎসুক প্যান্ডোরা একদিন বাক্সটি খুলে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অশুভ শক্তি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীজুড়ে।

নির্বাচন কমিশনারদের পৃথিবী বা দেশের চিন্তা ছিল না। চিন্তা ছিল নিজেদের পদ, সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। বাক্স খুলতে গিয়ে তাঁরা হয়তো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের রোষে পড়তে চাননি। বর্তমান কমিশন দাবি করতে পারে, যখন এই ঘটনা ঘটেছে, তাঁরা তো তখন দায়িত্বে ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা তো দায়িত্ব পেয়েছেন। পেয়েই কেন ব্যবস্থা নেননি?

গ্রিক পুরাণ বলছে, প্যান্ডোরা দ্বিতীয়বার বাক্সটি খোলার পর পৃথিবী উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়। ইসি যদি সেই সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিত, তাহলে বাংলাদেশে সাংবিধানিক সংস্থার সৌজন্যে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের আলো ছড়িয়ে পড়তে পারত। সেই সৎসাহস তারা দেখাতে পারেনি।

বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধযুক্ত পানি অনেকটা প্রবাহিত হওয়ার পর গত রোববার নির্বাচন কমিশন কেন তদন্ত কমিটি গঠন করল, তার আসল কারণ অজানা। সূত্রের খবর, কমিশনারদের কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে তদন্তের প্রয়োজনের কথা নিজেদের মধ্যে বলছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকেও বিষয়টি তদন্তে ইসিকে চিঠি দেওয়া হয়। কেউ কেউ মনে করেন, দুদকের কাছে সরকারের কোনো নির্দেশনা থাকতে পারে।

ইতিমধ্যে কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁকে ও তাঁর ভাইদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মন্ত্রীরা বলতে বাধ্য হচ্ছেন, আজিজ আহমেদ ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ তাঁদের লোক নন। দুই আহমেদের ওপর থেকে ক্ষমতার ছাতা সরে গেছে, তা স্পষ্ট।

এর মধ্যে প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে আসে, আজিজ আহমেদের দুই ভাই এবং তাঁদের স্ত্রীরা অসত্য তথ্যে ই-পাসপোর্ট নিয়েছেন। দুই ভাইয়ের এনআইডি নেওয়ার ক্ষেত্রে সুপারিশ করেছিলেন আজিজ আহমেদ।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তখন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মুখপাত্র ও ইসি সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সময়ে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে কেউ যদি একাধিক এনআইডি থাকার বিষয়ে এনআইডি শাখায় নির্দিষ্ট তথ্য দেয়, তাহলে সেটা তল্লাশি করে দেখা হবে।

ফলে দাঁড়ায় এমন যে সরকারি সংস্থার ভেতরে অনিয়ম হতে থাকবে; সাধারণ মানুষ নিজ উদ্যোগে তথ্য সংগ্রহ করে তাঁদের দেবে, তারপর তাঁরা খতিয়ে দেখবেন। নিজেদের বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি, গাড়ির সুবিধা, বিদেশযাত্রার সুবিধা—এসবের জন্যও তাঁরা কি সরকারের ইচ্ছার অপেক্ষায় থাকেন, নাকি চেষ্টা-তদবির চালাতেই থাকেন? আসলে সে ক্ষেত্রে তাঁরা খুবই সক্রিয়। কিন্তু প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই তাঁরা অভিযোগ না পেলে ‘এক পা-ও এগোতে’ রাজি নন। এগোলেও তাতে লাগে তিন বছরের বেশি সময়।

ইসির তদন্ত কমিটির খবর পাওয়া গেলেও ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর আজিজ আহমেদের ভাইদের মিথ্যা পরিচয়ে পাসপোর্ট নেওয়া এবং তথ্য গোপন করে বেনজীর আহমেদের পাসপোর্ট নেওয়ার বিষয়ে তদন্ত কমিটি করেছে বলে জানা যায়নি। দুদক আজিজ আহমেদের ভাইদের পাসপোর্ট নিয়ে তদন্তের জন্য চিঠি দিয়েছে বলে গত সোমবার গণমাধ্যম খবর দিয়েছে।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেনজীর আহমেদ পাসপোর্ট নিয়েছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে। তখন তিনি র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।

জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের মতো সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ নথি যদি মিথ্যা তথ্য দিয়ে তৈরি করা যায়, তাহলে তো জাতীয় নিরাপত্তার সংকট তৈরি হয়। তাই এখানে মিথ্যা তথ্য দেওয়া ঠেকাতে আইনে সুনির্দিষ্ট শাস্তির কথা বলা আছে।

আজিজ আহমেদের দুই ভাই পাসপোর্ট ও এনআইডি এবং বেনজীর পাসপোর্ট গোপনে নেননি। সবাই তা জানতেন। সবাই মিলে চুপ ছিলেন।

শেষ করি বেনজীর আহমেদের একটি বক্তব্য দিয়ে। ২০২২ সালের ৩০ মে তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘জনগণের ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে যাঁরা অবজ্ঞা করার দুঃসাহস দেখান, তাঁরা আহাম্মক।’ তিনি নিজেই এই ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করে সম্পদ গড়েছেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করেছেন; তারপর জনগণকে ‘আহাম্মক’ বানিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন।

রাষ্ট্র এখন ক্ষমতা দেখাক; যাঁরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছিলেন, নিতে সহায়তা করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।