মাস্টারমশাই হরলালের মৃত্যু হয়েছিল নির্জন রাতে ঘোড়ার গাড়িতে। তিন বছর পরও সে গাড়িতে অশরীরী এক অনুভব হতো সওয়ারিদের। বাংলা ১৩১০ সালেরও আগে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মাস্টারমশাই’ গল্পে ঘোড়ার গাড়ি ছিল এক রহস্যময় ব্যাপার।
ঘোড়ার গাড়ির আবেদন কমেনি কোনোকালেই। আশির দশকে বাংলাদেশে দর্শকের হৃদয় হরণ করেছিল বেদের মেয়ে জোসনা চলচ্চিত্র। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন পর্দায় উপস্থিত হয়েছিলেন টগবগে ঘোড়া ছুটিয়ে। ঘোড়া যে ক্ষমতা ও শক্তির প্রতীক, সে ধারণা পোক্ত করেছিলেন মোগল রাজশাসকেরা। তাঁদের হাত ধরেই ভারতবর্ষে এসেছিল আরবি ঘোড়া। সেই তেজি ঘোড়ার গল্প মানুষের কল্পনায় এখনো একই রকম আছে। আজও পুরান ঢাকার বিভিন্ন উৎসবে ব্যবহৃত হয় ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম।
গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পথে সওয়ারি নিয়ে চলে ঘোড়া। নাগরিক কোলাহলে হ্রেষা বা খুরের শব্দ পাওয়া যায় না। তবে ঘোড়ার পিঠে চাবুক হাঁকানোর শব্দ ঠিকই আসে। বঙ্গবাজারের পাশে বেঁধে রাখা ঘোড়াগুলো দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন, এককালে তাদেরও জৌলুশ ছিল। এখন চালকের সঙ্গে ঘোড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ঘোড়ামালিক আর চালকের সম্পর্ক ব্যবসায়িক হয়েছে বহুদিন ধরেই।
সিদ্দিকবাজারের মো. নিজামউদ্দিনের পরিবারের তিন প্রজন্ম ঘোড়ার ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। তাঁর সন্তানদের কেউ আর এই ব্যবসায় নেই। ৩৬ বছর ধরে তিনি ১৫টির বেশি ঘোড়া পুষেছেন। করোনাকালে খাবারের অভাবে মারা গেছে তাঁর চারটি ঘোড়া। গত ১২ আগস্ট বিকেলে সিদ্দিকবাজারে বসে কথা হলো মো. নিজামউদ্দিনের সঙ্গে। প্রথম আলোকে বললেন ‘ঘোড়া গোসল করিয়ে এবং ঘোড়সওয়ার নিজে পাক–পবিত্র হয়ে তারপর যাত্রা করার নিয়ম। ঘোড়া রাখতে হবে সন্তানের মতো যত্নে। এখন ঘোড়ার কাছে দুর্গন্ধে যাওয়া যায় না। চালকেরা নিজের পেশার মান্যগণ্য করে না। ফ্লাইওভারের তলায় রাখা ঘোড়াগুলো দেখলেই বোঝা যায় অবলা প্রাণীগুলোকে শুধু আয়ের জন্য বাঁচিয়ে রাখা হয়।’
সেদিন বিকেলে আনন্দবাজারের সামনে লাইন ধরে রাখা ছিল ১৬টি ঘোড়া। সারা দিন শ্রম শেষ করে তখন ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে। সবগুলোর হাড় গোনা যায় একপলক দেখে। চালক আর সাহায্যকারীরা কেউ ঘুমিয়ে আছেন, কেউ লুডু খেলছেন। পাশেই ময়লা ফেলার বিশাল সাবস্টেশন। সেখানেই মেলে রাখা আছে ঘোড়ার পিঠে দেওয়ার লাল আলোয়ান, যা শত ব্যবহারে মলিন ও অস্বাস্থ্যকর।
এখানে আছে টমটম সার্ভিসের কয়েকটি সাইনবোর্ড। ‘নবাবি ডিজিটাল টমটম সার্ভিস’–এর মালিক টুকু রাজা বললেন, ‘ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা সম্প্রতি বেড়েছে। মানুষ ঘোড়ার গাড়ি দেখে আবেগপ্রবণ হয়। তবে যাঁরা টমটম চালান, তাঁদের অধিকাংশ সাহায্যকারী অল্প বয়সের ভাসমান পথশিশু, যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ওরা রাতে পাহারার কাজও করে। কিছুদিন পর কাজ ছেড়ে দেয়।’
এখনকার ঘোড়ার খাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গবাজারের টমটমচালক শুক্কুর বললেন, ‘ঘোড়াকে খাওয়ানো হয় গমের ভুসি, বুটের ছোলা, ধানের গুঁড়ি আর কাটা ঘাস। দিনে এক জোড়া ঘোড়ার জন্য খরচ হয় গড়ে পাঁচ শ টাকা। এই টাকা আয় করা কঠিন। তাই ঘোড়ার এমন দুরবস্থা।’
ঘোড়ার জৌলুশকালের সঙ্গে একেবারেই মিল নেই বর্তমানের। আবুল ফজল আইন-ই–আকবরীতে লিখেছেন, আকবর বাদশাহর সময় খাস আস্তাবলের প্রতিটি ঘোড়ার প্রতিদিনের খোরাকি ছিল সাত সের গম ও যব, দুই সের ময়দা, আধসের চিনি ও আধসের ঘি।
টমটম গাড়ির সুদিনের কথা বোঝা যায় রাজধানীর নাজিরাবাজারের নাজির মামাকে নিয়ে শোনা গল্প থেকে। সেদিন সিদ্দিকবাজারের কয়েকজন টমটমচালক বললেন, ‘নাজির মামার ছিল “ভাওয়াল রাজার গাড়ি” নামে রুপার তৈরি ঘোড়ার গাড়ি। ভাড়া দেওয়া হতো চলচ্চিত্রের জন্য। দিলীপ কুমারের কোনো এক সিনেমার জন্যও নাকি একবার নেওয়া হয়েছিল। গাড়ির আসল মালিক ছিল গাজীপুরের ভাওয়াল রাজা। পাকিস্তান আমলে নিলামে সে গাড়ি এসেছিল নাজির মামার হাতে।’
১৯৫১ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র দিদার এ নায়িকা নার্গিসকে নিয়ে ছদ্মবেশে রওনা হয়েছিলেন নায়ক দিলীপ কুমার। ঘোড়ার রাশ টানতে টানতে নকল দাড়ি, গোঁফ খুলে স্বরূপে প্রকাশ করেন নিজেকে। সে ঘোড়া রাজধানীর নাজির মামার ছিল কি না, আমাদের জানা নেই। দিলীপ কুমারের সেই ছদ্মবেশ সরিয়ে নিজেকে প্রকাশের মতো এই পেশার সংকটগুলোও প্রকাশ্য হওয়া উচিত। তবেই যদি বদলায় হাড়জিরজিরে ঘোড়াগুলোর অবস্থা।