বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে অনেক ‘নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের’ শত শত নিবন্ধ নানা সময় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করা হয়েছে। তবে এসব লেখকের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংবাদ সংস্থা এএফপির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব বিশেষজ্ঞ লেখকের অনেকের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকি নিবন্ধে তাঁদের ভুয়া ছবি ব্যবহারের কথাও জানা গেছে।
পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, আগামী জানুয়ারিতে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘অস্তিত্বহীন বিশেষজ্ঞদের’ এসব নিবন্ধ ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার অবিরাম প্রচারণার অংশ। সেই সঙ্গে এই প্রক্রিয়াকে শেখ হাসিনার সরকারকে লাভবান করার উদ্যোগ বলেও মনে করছেন তাঁরা।
এসব নিবন্ধ চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সিনহুয়াসহ এশিয়াজুড়ে বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এসব নিবন্ধে ওয়াশিংটনভিত্তিক ফরেন পলিসি সাময়িকীর সাউথ এশিয়া ব্রিফের বরাত দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচক এবং রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনের চেষ্টায় উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।
এএফপির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে মতামত–নিবন্ধ লিখছেন ও প্রকাশ করছেন। তাঁদের অনেকে নিজেদের পশ্চিমা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচয় দেন। কেউ কেউ চুরি করা হেডশট ছবি (নিবন্ধে ব্যবহার করা লেখকের ছবি) ব্যবহার করেছেন। কেউবা অন্য বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষকের মন্তব্য থেকে ভুয়া উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন এএফপিকে বলেন, ‘এটি সমন্বিতভাবে প্রভাব খাটানোর একটি চেষ্টা। কেননা এসব নিবন্ধের মূল বক্তব্যই হলো বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের অনুকূলে বয়ান তৈরি করা।’
এসব নিবন্ধের বেশ কিছু গত বছরের সেপ্টেম্বরে অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে। ওই সময়টাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক প্রচারণা’ রুখতে ‘ভালো কলাম লেখকদের’ এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে অনেক ‘অস্তিত্বহীন বিশেষজ্ঞের’ নিবন্ধের বিষয়ে জানতে পররাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে এএফপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তবে তাঁরা কোনো উত্তর দেননি।
এসব লেখকের সম্পর্কে জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মন্তব্য করার জন্য তাঁর হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই।
সাত শতাধিক নিবন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখেছে এএফপি। এসব নিবন্ধ ৬০টির বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নিজ নামে লিখেছেন ৩৫ জন ‘বিশেষজ্ঞ–বিশ্লেষক’। গত বছরই প্রথম এঁদের বেশির ভাগেরই জীবনে প্রথম লেখা অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের নিবন্ধের অনেকগুলো বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও আপলোড করা হয়েছে।
এই ৩৫ লেখকের অনেকেই কট্টর চীনপন্থী। নিজেদের নিবন্ধে ওয়াশিংটনের তীব্র সমালোচনা করেছেন তাঁরা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ঢাকাকে পশ্চিমাদের সতর্ক করে দেওয়ার বিষয়টি নিবন্ধে উঠে এসেছে।
যদিও এএফপির অনুসন্ধানে এই ৩৫ জন বিশেষজ্ঞ লেখকের বাস্তবে অস্তিত্ব রয়েছে কি না, তা সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে দেখা গেছে, তাঁদের লেখা কোনো নিবন্ধ গত বছরই প্রথম অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের কারোরই অস্তিত্ব নেই। বিশ্বের স্বীকৃত কোনো জার্নালে তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়নি।
অনুসন্ধানে ওই ৩৫ জন বিশেষজ্ঞ লেখকের মধ্যে ১৭ জন নিজেদের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন পশ্চিমা ও এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে পরিচয় দিয়েছেন। তবে এএফপির অনুসন্ধানী প্রতিবেদকেরা এর কোনো সত্যতা খুঁজে পাননি।
এর মধ্যে নয়জন বিশেষজ্ঞ লেখক নিজেদের বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে পরিচয় দিয়েছেন। এ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার ইউনিভার্সিটি, কানাডার টরেন্টো ইউনিভার্সিটি, সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন ইউনিভার্সিটি এবং সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মতো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এসব লেখককে চেনে না। তাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসব নামের কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ততা নেই।
সন্দেহভাজন এক লেখকের বিষয়ে জানতে এএফপির পক্ষ থেকে ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘আমরা আমাদের নথিপত্র ঘেঁটে দেখেছি, এই নামের কেউ আমাদের নথিপত্রে নেই।’
তথাকথিত আটজন লেখক নিবন্ধে নিজেদের যে ছবি ব্যবহার করেছেন, তা ভুয়া—অনুসন্ধানে এমনটাই জানিয়েছে এএফপি। এসব নিবন্ধে জনপ্রিয় ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারসহ ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করা অন্য মানুষের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
এমনকি এএফপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একই নিবন্ধ ইংরেজি ও বাংলায় ভিন্ন লেখকের নাম ব্যবহার করে প্রকাশ করা হয়েছে।
এসব লেখকের মধ্যে একজনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে ডরিন চৌধুরী। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে তাঁর লেখা অন্তত ৬০টি নিবন্ধ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। এসব নিবন্ধে তিনি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রশংসা করেছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বন্দুক হামলা নিয়েও নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। বলেছেন, এসব হামলার কারণে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
লেখকের নামের পাশে ডরিন চৌধুরীর যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে, তা ভুয়া। ওই ছবি ভারতীয় একজন অভিনেতার। নিজের পরিচয় হিসেবে ডরিন চৌধুরী বলেছেন, তিনি নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই নামে তাদের কোনো নিবন্ধিত শিক্ষার্থী নেই।
সংবাদমাধ্যম ব্যাংকক পোস্ট এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের একটি ব্লগ পোস্টে নিবন্ধ লিখেছেন ফুমিকা ইয়ামাদা। তিনি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন। এএফপির অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই নামে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে নথিভুক্ত কেউ নেই। এমনকি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়ে গবেষণার আলাদা কোনো ক্ষেত্র নেই।
নিবন্ধে শেখ হাসিনাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শক হিসেবে তুলে ধরেছেন ফুমিকা ইয়ামাদা। এমনকি গণতন্ত্র ও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের জন্য ওয়াশিংটনের তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। তাঁর মতে, এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।
এ ছাড়া অনেক নিবন্ধে কোনো বিশেষজ্ঞ–বিশ্লেষকের এমন মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, যা ওই ব্যক্তি কখনোই বলেননি বা লিখেননি।
নেদারল্যান্ডসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক জেরার্ড ম্যাককার্থি জানান, মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে ‘পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর লেখক পৃথ্বীরাজ চতুর্বেদী নামের একজন। ওই নিবন্ধে তাঁর (ম্যাককার্থি) একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। ম্যাককার্থির ভাষ্য, এ উদ্ধৃতি সম্পূর্ণ বানোয়াট।
শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে ‘অস্তিত্বহীন বিশেষজ্ঞের’ নিবন্ধ প্রকাশের ঘটনা নিয়ে এএফপির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক ও সম্পাদকের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা বলছেন, লেখকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা প্রভাবশালী কোনো সংবাদমাধ্যমে তাঁদের লেখা প্রকাশিত হতে দেখে সরল বিশ্বাসে তাঁরা এসব নিবন্ধ ছেপেছেন।
এ বিষয়ে ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ফিচার সম্পাদক মুবিন এস খান বলেন, ‘আমরা লেখকদের পরিচয়ের ওপর আস্থা রেখেছিলাম।’
অন্যদিকে নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, ২০২৩ সালের শুরুর দিকে তাঁর কাছে কিছু মতামত–নিবন্ধ পাঠানো হয়েছিল। এসবের বেশির ভাগ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে লেখা। এসব লেখার কিছু তিনি তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। পরে প্রকাশ করা বন্ধ করে দেন।
নূরুল কবির বলেন, তাঁর মনে হয়েছিল, এসব নিবন্ধ–মতামতের লেখকদের অনেকে ভাড়াটে। কিংবা এসব লেখক কারও সুনির্দিষ্ট স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করছেন। পরে লেখকদের পরিচয় না পেয়ে অবাক হন তিনি। তাই লেখা প্রকাশ বন্ধ করে দেন।
এ বিষয়ে সতর্ক করে নূরুল কবির আরও বলেন, ‘ভুয়া তথ্য ও অপপ্রচারের এই সময়ে লেখকদের পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আমার আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল।’
এএফপির ফ্যাক্টচেক সম্পাদক কদরউদ্দিন শিশির–এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম