‘বিশ্বমানের ক্যানসা চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ২১ অক্টোবর।
‘বিশ্বমানের ক্যানসা চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ২১ অক্টোবর।

দেশেই চিকিৎসা

ক্যানসার চিকিৎসা শেষে টানা দুই বছর ফলোআপ জরুরি

‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত গ্লোবক্যানের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যার মধ্যে স্তন ক্যানসারের সংখ্যাটা বেশ ওপরের দিকে। আর এ ধরনের ক্যানসার নারীদেরই বেশি হয়ে থাকে।’

দেশের ক্যানসারবিষয়ক পরিসংখ্যান নিয়ে বলছিলেন স্কয়ার হসপিটাল লিমিটেডের অনকোলজিবিষয়ক কনসালট্যান্ট ডা. অরুণাংশু দাস। এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার কেন হয়, কীভাবে নির্ণয় করতে হয়, ডায়াগনসিসের বিভিন্ন উপায়, চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. অরুণাংশু দাস। ২১ অক্টোবর পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্তন ক্যানসার নিয়ে জরুরি কিছু তথ্য দেন উপস্থাপক নাসিহা তাহসিন। তিনি বলেন, বিশ্বে যত ধরনের ক্যানসার আছে, তার মধ্যে অন্যতম স্তন ক্যানসার। দেশে প্রতিবছর প্রায় ১৩ হাজার নারী এ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যার মধ্যে সাত হাজারের বেশি মারা যান। তবে সঠিক সময়ে শনাক্ত করা গেলে এর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার হার ৯৯ শতাংশ।

স্তন ক্যানসার কি বংশগত রোগ? উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘হ্যাঁ, এটি বংশগত রোগ। কোনো নারীর মা-বোনের বা নানি-খালাদের যদি স্তন ক্যানসার থাকে, তাঁরও এটি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে মা-বোনের থাকলে ঝুঁকিটা তিন গুণ বেশি, যাঁদের “ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভ” বলা হয়।’ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে এ ধরনের ক্যানসারের সম্পর্ক বিষয়ে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো না মানলে স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত চর্বি ও মাংসজাতীয় খাবার গ্রহণ, শাকসবজি কম খাওয়া, ফাস্টফুড বেশি খাওয়া এবং অ্যালকোহল গ্রহণ করা। আর জীবনযাপনের মধ্যে রয়েছে ব্যায়াম না করা, হাঁটাচলা কম করা, কায়িক শ্রম না করা।’

স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে কি প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণ কার্যকরী? উপস্থাপকের এ প্রশ্নের জবাবে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘স্ক্রিনিং করাই হয় প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তের জন্য। কারণ, “আর্লি ডিটেকশন” হলে ক্যানসার দ্রুত নিরাময়যোগ্য। আর্লি স্টেজ মানে হলো ক্যানসারের পর্যায়-১ ও ২। তাই যাঁদের বয়স ৪০-এর বেশি, তাঁরা মেমোগ্রাম করাবেন। এটার ধরন তিনটি। প্রথমত, সেলফ ব্রেস্ট এক্সামিনেশন, অস্বাভাবিক কিছু পেলে তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। সেখানে তাঁর ক্লিনিক্যাল এক্সামের পর চিকিৎসক আলট্রাসনোগ্রাম করবেন। এরপর মেমোগ্রাম করতে হয়। যাঁদের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, তাঁদের এ ধরনের পরীক্ষা করা অবশ্যই দরকার। কিন্তু ঝুঁকিতে থাকলে বয়স ৩০ হলেই করা উচিত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমআরআই করার পরামর্শ দেওয়া হয়।’

স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে ‘জেনেটিক হিস্ট্রি’র ভূমিকা সম্পর্কে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘এটি গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে “বিআরসিএ-১ ও ২” পরীক্ষা বলা হয়। রক্তের মাধ্যমেই এ পরীক্ষা করা হয়। যদি কারও বংশগত হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর এ পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।’

বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান অবস্থা, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার সুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. অরুণাংশু দাস (ডানে)।

অনুষ্ঠানের এক দর্শক ফেসবুক কমেন্টের মাধ্যমে প্রশ্ন করেন, ‘খালা-ফুপির যদি ক্যানসার থাকে, তাহলে সেই মেয়ে বা নারীর ঝুঁকি কতটুকু?’

উত্তরে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘ফুপির হলে এতটা জরুরি নয় কিন্তু খালার যদি থাকে, তাহলে ঝুঁকি রয়েছে।’

আর কী কী পরীক্ষার মাধ্যমে স্তন ক্যানসার শনাক্ত করা যায়? উত্তরে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘যেকোনো ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রথমে “কোর বায়োপসি” করা হয়। তারপর কিছু ধরা পড়লে স্টেজিং টেস্ট করতে হয়। এটার মাধ্যমে ক্যানসারের পর্যায়টা জানা যায়। চিকিৎসা করতে গেলে পর্যায়টা জানা জরুরি। এখানে বলে রাখা জরুরি, চিকিৎসার জন্য একটা বোর্ড গঠিত হয়। যেখানে অনকোলজিস্ট, সার্জন, রেডিয়েশনিস্টসহ প্রয়োজনবোধে আরও অনেকে থাকেন। যেটাকে বলা হয় “মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি টিউমার বোর্ড”। মূলত তাঁরাই চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করেন।’

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজি বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র ইউজিএমপি ও অ্যানভিজা ব্রাজিল অনুমোদিত প্ল্যান্ট। ফলে এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৭টি দেশে ও দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি হচ্ছে।

কেমো, রেডিও, হরমোন ও ইমিনো থেরাপি প্রসঙ্গে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘এগুলো ক্যানসারের পর্যায় অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়। মোটাদাগে বললে, স্তন ক্যানসার চিকিৎসার চারটা মডালিটি বা পদ্ধতি রয়েছে। অপারেশন বা সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোন থেরাপি। কেমোথেরাপি খুবই কার্যকরী। এটি আর্লি ও অ্যাডভান্স স্টেজে এবং সার্জারির আগে বা পরে দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া যেখানে সার্জারি কার্যকরী নয়, তখনো এটা দেওয়া হয়ে থাকে। আর রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় যখন কেমো ও সার্জারি হয়ে যায়। বর্তমানে রেডিওথেরাপির অনেক আধুনিকায়ন হয়েছে। আগে স্তনে ২৫-৩০টা রেডিয়েশন ছয় সপ্তাহের মধ্যে দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে যা তিন সপ্তাহে দেওয়া যায়। শিগগিরই আরও কম সময়ে এবং মাত্র পাঁচটি রেডিয়েশনের মাধ্যমে এ চিকিৎসা সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া হরমোন থেরাপিও আধুনিক হয়েছে, যা বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এখন আর থেরাপি দেওয়া লাগে না, মুখে খাওয়ার হরমোন ট্যাবলেটেই রোগীরা সুস্থ হচ্ছেন। আর ইমিনো থেরাপি হচ্ছে স্তন ক্যানসারের সর্বোচ্চ আধুনিক ধাপ। বাংলাদেশেও এ মাধ্যমে চিকিৎসা হচ্ছে। এটি “ত্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার”-এর ক্ষেত্রে বেশ কার্যকর।’

ক্যানসার চিকিৎসা শেষে ফলোআপের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর কমপক্ষে টানা দুই বছর ফলোআপ করতে হয় তিন মাস পরপর। কারণ, চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরের এক বছর ক্যানসার ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে।’

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানান, এসকেএফ অনকোলজির সারা দেশে রয়েছে ৩৩টি সেবাকেন্দ্র, যার মাধ্যমে ক্যানসারের ওষুধ পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, ঘরে বসে অর্ডার করলেই বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে সহজেই পৌঁছে দেওয়া হয়।

স্তন ক্যানসারের দেশ ও বিদেশের মধ্যে চিকিৎসাব্যবস্থার পার্থক্য সম্পর্কে ডা. অরুণাংশু দাস বলেন, ‘ক্যানসারের সব ধরনের চিকিৎসাই বাংলাদেশে রয়েছে। তবুও কেউ কেউ দেশের বাইরে যান, কারণ নিজের রোগ নিয়ে সেখানকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতামত নিতে চান। অনেকেই সেই মতামত নিতে পেরে যখন দেখে দেশেও একই পদ্ধতিতে চিকিৎসা হবে, তখন দেশে ফিরে আসেন।’