আজও ছায়ার মধ্য খিড়কির পাল্লা ধরে লটকে আছে সে। যেভাবে তারও ওপরের কাঁটাতারে ঝুলে আছে বিষন্ন কাক আর সন্ধ্যা পেরোনো বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রহরের ঘ্রাণ।
বখতিয়ার, তুই নাকি খুন করে এসেছিস?
কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে। এমন শব্দ এর আগে তাকে যখন দিশাহারা করে দিচ্ছিল, সে পালাতে পালাতে এখানের এই নির্জনে এসে আশ্রয় নিয়েছে। দুবাইয়ে থাকা তার ছোটবেলার বন্ধু তাকে বিশাল জমির কিনারের এই বাড়িটায় একেবারে গোপনে বাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। দূরবর্তী সামনের মুদিদোকানের এক পিচ্চি এসে তার খোঁজখবর নেয়। বাজার করে দিয়ে যায়। আশ্চর্য!
মফস্সলের শহরতলির এ বাড়িটার দক্ষিণে জলাভূমি এবং বসন্তকাল শেষ হওয়ার পরও ঝাঁক ঝাঁক কুয়াশায় কিছুই দেখা যায় না। নিচে জলের বাহার। তার ওপরে অহর্নিশ লটকে থাকে সে, যেন বাদুড়।
তার অশরীরী চোখ সব ফেলে শহরের জানালাকে নিজের সঙ্গে এখানে নিয়ে এসেছে। যখন রক্তপাতের শব্দে বখতিয়ার প্রায় উন্মাদ বোধ করে, তখনই সেই খিড়কির মধ্যে গিয়ে বসে।
ছোটবেলায় সে বানরনাচ দেখত খুব। বানরের গতিবিধি সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করতে করতে নিজের মধ্যে বানরের উপস্থিতি অনুভব করে। এ একেবারে বখতিয়ারের নিজস্ব অনুভব, যা সে অন্যের সামনে কঠিনভাবে গোপন করে। সে স্পষ্ট দেখতে পায়, দুধ–আলতা মেশানো এক নারী সারা ঘরে সঞ্চরণ করছে। যখন সে এটা দেখে, কেবল তখনই অন্ধকার নরক থেকে বেরিয়ে সুস্থ বোধ করে, এমনকি সুখীও।
বখতিয়ার নিজের গেটআপ যথাসম্ভব পাল্টে ফেলেছে পুলিশ, সাংবাদিক আর টিকটকারদের ভয়ে। ঘরভর্তি কাগজ। সে সারা দিনের রান্না এক বেলায় সেরে বাকি সময় উপন্যাস বা হাবিজাবি লেখার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে।
সেদিন দুপুরবেলা দুটো ঘটনা ঘটেছিল—বখতিয়ারের শৈশবের প্রেমিকা বুলবুলি, যার বিয়ের কথা হচ্ছে বলে সে বিভ্রান্ত বোধ করছিল এবং ওর বাসায় গিয়ে বুলবুলির অবুঝ কান্না থামাতে বলেছিল, ‘আমরা এর মধ্যেই বিয়ে করে ফেলব। পড়াশোনা পরে দেখা যাবে।’
পরে ঘামের গন্ধে চুবে–ডুবে শরীর ও সম্পর্কে এক হয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল সহপাঠী অপুর বাসায়। বাবার চাকরির কারণে অপু ইরানে ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর পরে সন্তানকে নিয়ে তার মা এ দেশে এসেছেন বেশি দিন হয়নি।
মায়ের কাছ থেকে মোটামুটি ভালোই বাংলা শিখেছে অপু। কিন্তু ভার্সিটিতে বখতিয়ারের তুখোড় সাহিত্যবোধ দেখে সে জানায়, তার মারও বাংলা লিটারেচারের প্রতি দারুণ আগ্রহ। ফলে বাংলাটা আরও সমৃদ্ধ করার ইচ্ছে তার।
বখতিয়ার ড্রয়িংরুমে বসেছিল। সারাটা ঘরে অপূর্ব শিল্পের কারুকাজ। আর স্নিগ্ধ ঘ্রাণ। অপু কী কাজে যেন ভেতরে গিয়েছিল। তক্ষুনি এক ফিনফিনে তরুণী ঘরে ঢুকতেই বখতিয়ার তাৎক্ষণিক সেই ঘ্রাণের উৎস খুঁজে পেয়ে একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়ে।
অপু বলেছিল, মায়ের বয়স যখন পনেরো পেরোচ্ছে, তখন নাকি তার জন্ম। তাই বলে একজন তরুণ ছেলের মায়ের সদ্য যৌবনের অবয়ব? ছিপছিপে অসহ্য এক সুন্দরী নারী, সহসা দেখাতেই বখতিয়ারকে একেবারে নিজের সঙ্গে বিঁধে ফেলবে—এ ছিল তার দূরবর্তী কল্পনার বাইরে।
‘এই বসো বসো’, মহিলার কণ্ঠ সাবলীল, ‘অপুর কাছে তোমার অনেক কথা শুনেছি।’ চায়ের সঙ্গে কাপের টুংটাং শব্দ চলতে থাকে।
এরপর বলেন, ‘আমি মেহজাবিন আখতার নামে টুকটাক লেখালেখি করি।’ বলেই প্রচণ্ড লজ্জা নিয়ে হাসেন, ‘লেখাগুলো একেবারেই খসড়ার মতো, কিন্তু বই পড়তে আমি খুব পছন্দ করি।’
বখতিয়ারের নখ থেকে চুল অব্দি মৃদু তরঙ্গের ছোটাছুটি শুরু হয়, ‘আপনার বাবা–মা কি ইরানি?’ কম্পিত ঠোঁটে প্রশ্ন করে সে।
হাসির ঝংকার চারপাশে আছড়ে পড়ে, ‘মা ইরানি, বাবা পুরাই বাঙালি, কেন আমাকে দেখতে ইরানিদের মতো লাগে?’
কার্পেটে পায়ের বুড়ো নখ ঘষটায় বখতিয়ার।
চা হাতে তুলে দিয়ে সোফায় বসে তিনি বলেন, ‘তোমার নিজের পছন্দের একটা কবিতা শোনাও। অপুর কাছে তোমার কবিতার খুব প্রশংসা শুনেছি।’
‘উপন্যাস শোনাই?’ অসতর্ক মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। আর এমন একটা কথা বলেই বখতিয়ার মহাবিব্রত বোধ করে।
মহিলা গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘তুমি আমার সাথে ফাজলামো করছ?’
‘আরে না না’, বলতে বলতে সে টের পায়, ভেতর থেকে বহুদিন পরে বানরগুলো উসকানি দিচ্ছে। ফলে হঠকারীভাবে কাউকে কিছু না বলে সেই নারীর ‘আরে! আরে!’ শব্দের মধ্য দিয়ে সে ছুটতে ছুটতে বাইরে বেরিয়ে আসে।
সেই থেকে বখতিয়ার অদ্ভুত এক আঁধারের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলতে শুরু করে। যখনই কোনো মেয়ে তার কাছে এসেছে, তক্ষুনি সে টের পেয়েছে, তার ভেতর বান্দরদের মহোৎসব শুরু হয়েছে। এই বানরদের উসকানির কারণে একাধিক মেয়ে এসেছে তার জীবনে। তাদের সঙ্গে শরীর–সম্পর্ক হয়েছে। বুলবুলি এর কিছুই টের পায়নি। কিন্তু বুলবুলিকে সে বিয়ে করবে—ব্যাপারটা অবশ্য নিজের ভেতরে চূড়ান্তই করে রেখেছিল। বুলবুলির সঙ্গে তার আত্মার শিকড় বাঁধা ছিল।
তবে কাউকে দেখেই কারও ভেতরে আগুন ধরে যাওয়ার বিষয়টা তার কাছে সব সময়ই মান্ধাতা আমলের ব্যাপার মনে হতো।
এবার এমন হলো যে!
বখতিয়ার নিজেকে চিনতে পারছে না। ভেতরে–বাইরে নিজের কাছেই অচেনা হয়ে ওঠা বখতিয়ার কীভাবে কী করবে? প্রচণ্ড অসহায় হয়ে ওঠে সে; এবং কোনো দিন যে আর ওই নারীর মুখোমুখি হতে পারবে না, তা নিশ্চিত করেই বুঝে যায়।
এরপর প্রথমেই বখতিয়ারের ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ হয়। কারণ, সে টানা কদিন সেই বাড়ির চারপাশে চক্কর খেয়ে একসময় পেছনের দিকে একটা দেয়াল আবিষ্কার করে, যার সামনে অসংখ্য গাছপালা। রাজধানীতে এত গাছপালা তার চোখে পড়েনি। এরপর ক্রমে সে সেখানেই লটকে যায়, কখনো ছায়া–বিকেল, কখনো মায়াসন্ধ্যা পেরিয়ে চতুর–চক্ষু মেলে থাকে জানালার টানা পর্দার একফালি ফোকর দিয়ে। প্রায় নিশ্বাস আটকে দেখতে থাকে মেহজাবিনের হঠাৎ হঠাৎ ঘরে ঢুকে নানা রকম গতিবিধি। বেশির ভাগ সময় ঘরের কোণ, যা এখান থেকে দেখা যায় না, মেহজাবিন বসে কী যেন করে।
একদিন মেহজাবিন গোসল থেকে পেটিকোট পরে বেরিয়ে সুডৌল স্তন থেকে চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে কাপড় চেঞ্জ করে। পুরো ঘটনার বিহ্বলতায় বখতিয়ারের পুরো অস্তিত্বে রীতিমতো তুফান জ্বর ওঠে, শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়, কোনোরকম দেয়াল খামচে বহু কষ্টে সে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে। এরপর মেহজাবিন মোবাইল চাপতে চাপতে ভেতরে যেতে যেতে কাকে যেন বলে, ‘আমার বাথরুমের শাওয়ার ঠিক করাতে হবে।’
তার মানে এটা বেডরুম নয়।
বেডরুম কোন দিকে?
সন্ধ্যার পরে প্রায়ই মেহজাবিন এই ঘরে আসে। চেয়ারে হেলান দিয়ে গান শোনে। রিল দেখে একা একা হাসে। যখনই সে জানালার কাছে মুখ বাড়ায়, মুহূর্তেই বখতিয়ার নিজেকে অন্য দিকে টেনে নেয়।
সারা দিন বাড়িতে পড়ে থেকে যেন ক্ষুধার্ত মশা রক্তের জন্য অপেক্ষা করছে—এটা উদাহরণমাত্র। আসলে বখতিয়ার রক্ত সহ্যই করতে পারে না। রক্তে সে একেবারে এলোমেলো হয়ে যায়।
এভাবে প্রতিদিন সে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করে। কখনো মেহজাবিনের একেবারে উদোম দেহ দেখার বাসনায় তার সমস্ত স্নায়ুতে আগুনতৃষ্ণা জন্মায়; এবং কোনো এক পুরুষের জন্য মেহজাবিন বিছানায় ছটফট করছে—এমন কিছু দৃশ্যের অপেক্ষায় প্রতিদিন সে রোদ পড়লেই দেয়ালের মধ্যে উন্মাদের মতো লটকে পড়ে।
বুলবুলির ফোন অবিশ্রান্ত বেজে যায়। সে ধরে না। অগত্যা মেয়েটাকে বখতিয়ার টেক্সট পাঠায়, ‘বাড়িতে তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপার জানাজানি হয়ে গেছে। কিন্তু তারা কিছুতেই ছাত্র অবস্থায় আমাকে বিয়ে করতে দেবে না, ভার্সিটির খরচ চুকিয়ে দেবে। তুমি কদিন একটু শান্ত থাকো, আমি ঠিকই একটা ব্যবস্থা করব।’
এমনিতেই ডাকাবুকো বলে পরিচিত বুলবুলি। কিন্তু বখতিয়ারের ব্যাপারে সে এতই দুর্বল, কাছে গেলেই নেতিয়ে পড়ে নিজেকে ছারখার হতে দেয়।
অপুর ফোনও সে ধরে না। কেবল নিজে নিজে বিড়বিড় করে, আমি আগের বখতিয়ার নই, তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই নেই, এই আমি এখন অন্য কেউ।
এটা বেডরুম না হলে এটা মেহজাবিনের কোন রুম? পর্দা আজ একটু বেশি খোলা থাকায় শূন্য ঘরে গলা বাড়ায় সে। ওপাশে চেয়ার–টেবিল আছে। তার ওপরের শেলফে তাক তাক করে সাজানো বই।
ওহ! স্টাডিরুম! এত ভালো কবিতা লেখে বখতিয়ার, তারপরও ভাইবোনের সঙ্গে ঠাসাঠাসি করে যেন শূন্যে লটকে তাকে লেখালেখি করতে হয়। বানরগুলো উসখুস করে, মেহজাবিনের সঙ্গে সঙ্গে তার ঈর্ষাতুর জীবনটাও বখতিয়ারের চাই। বখতিয়ার যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।
একদিন দেয়ালের ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁজালো আলো চোখ ঠিকরে দেয়। সে একেবারে কুকুরের মতো নিজের মাথা পারলে দু–পায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে ফেলে। অতঃপর শব্দহীন। ধীরে ধীরে গলা বাড়িয়ে সে স্তব্ধ হয়ে যায়, গুনগুন শেষ করে বিছানায় হেলান দিয়ে মেহজাবিন মুখের সামনে মেলে ধরেছে বখতিয়ারের স্যাটায়ারধর্মী কবিতার বই—বখতিয়ারের বানরগুলো। কিছুক্ষণ পরে থরথর কম্পিত অবয়ব নিয়ে উল্টোমুখী হামাগুড়ি দিতে দিতে সে শোনে, মেহজাবিন শব্দ করে বখতিয়ারের কবিতা পড়ছে!
বখতিয়ার বুঝে যায়, এ নারীকে জীবনের জন্য পাওয়া আর কঠিন কোনো বিষয় নয়। সে একেবারে দ্বিধাহীন চিত্তে সোজা বুলবুলির বাসায় চলে যায়। বেশ কদিন ধরে বুলবুলির বাবা–মা বাড়িতে। ডিভোর্সি বড় বোন তাকে দেখে হামলে পড়ে, ‘দেখো, দিনরাত না খায়াদায়া আমার বোনের কী অবস্থা হইছে। তুমি এদ্দিন কই আছিলা?’
এর মধ্যেই নিজের জীবন থেকে বুলবুলিকে তাড়ানোর সব প্ল্যান করে ফেলেছে বখতিয়ার।
আলো কমে যাওয়া বাল্বের জন্ডিস আলোয় ডাকাবুকো সাহসী বুলবুলিকে চেনা যাচ্ছে না, কী রুক্ষ আর মলিন হয়ে গেছে! ধীরে ধীরে তার মাথাটা বুকে নিয়ে একেবারে দ্বিধাহীনভাবে মেহজাবিনের সঙ্গে তার প্রেমকাহিনি রসালভাবে বয়ান করতে থাকে বখতিয়ার। কেনাকাটা করতে বড় বোন বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু এত সব কথা শুনেও বুলবুলির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই যে! ঈর্ষা, যন্ত্রণা প্রকাশের বদলে বুলবুলি নিষ্প্রভ!
বখতিয়ারের উল্টো ক্রোধ বেড়ে যায়। বুলবুলির মধ্যে সে তার প্রতি ঘৃণার দাউ দাউ আগুন জ্বালাতে আগের সব শারীরিক সম্পর্কের কথা জান্তব বর্ণনায় বয়ান করতে থাকে। পরমুহূর্তেই তার মনে হয়, আগের বখতিয়ার এসব কথা বুলবুলিকে এত বিকারহীনভাবে বলার কথা কল্পনা করতেও কি পারত?
একসময় বুলবুলির মধ্যে প্রচণ্ড বেগে বমি ঠেলে ওঠে। এক হাতে মুখ চেপে অন্য হাতে ঠেলে বখতিয়ারকে ঘর থেকে বের করে দিতে গিয়ে তার পিঠের মধ্যে একটা লাত্থি মারে সে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘কুত্তার বাচ্চা, দেখ আমি তোরে কী করি?’
হুমড়ি খেয়ে বাইরে পড়তেই বখতিয়ারের বানরগুলো চারপাশে তাকিয়ে তাকে যেন সোজা করে আঁচড়ে দেয়। সে যখন ফিনফিনে বাতাসে উড়তে উড়তে অনেক দূর চলে এসেছে, তাদের দুজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিজান, যে নিজেও বুলবুলির প্রতি খুব দুর্বল, সে বখতিয়ারকে ফোন করে, ‘তুই নাকি বুলবুলিকে ছুরি দিয়া খুন করতে চাইছস?’
‘কী?’ বখতিয়ারের মাথায় গিট্টু লেগে যায়, ‘তোর মাথা খারাপ হইছে? ছুরি দিয়া? আমি?’
‘তুই এখন বুলবুলির কাছে যা, আমার কিছু ঠিক লাগতেছে না।’
বখতিয়ারের স্থবির পা কিছুক্ষণ রাস্তায় ঠেসে থাকে। পরে যখন মাথার কোষ সব আলগা হয়ে যাচ্ছে, সে ছুটে বুলবুলির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপর ভেতরের দৃশ্যের সঙ্গে ক্রমাগত নিজেকে গেঁথে ফেলে।
এই এলাকায় পালিয়ে আসার পরে এই প্রথম যেন বখতিয়ার নিজের সামনে নিজেকে দাঁড় করাতে পারে। এত দিন সে স্বপ্ন আর বাস্তবতার বিভ্রমের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখছিল। ক্রমে ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে যেন এই প্রথম তার হুঁশ হয়।
নিজের বুকে ছুরি বসিয়ে ছটফট করতে থাকা বুলবুলি তার হাতের মধ্যেই নিথর হয়ে গিয়েছিল। ওহ, রক্ত! সিনেমার দৃশ্যের মতো ঘরে ঢুকে বড় বোনের চিৎকারের রেশ যত দূর যায়, বুলবুলির বুক থেকে অসতর্ক হাতে ছুরি তুলে নিয়ে সে তত দূরে ছুটতে ছুটতে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া আলো–অন্ধকারময় এলাকা পেরিয়ে লেকের সামনে এসে হাঁপ ছাড়ে। এই পাশটা নির্জন। প্রথমেই নিজেকে জলে ডুবিয়ে সারা শরীরের ভয়াবহ রক্ত থেকে মুক্তি পেতে চায় সে। জলের ভেতর পা বাড়াতেই যেন তার চেতনা ফেরে, পুরো দেহে যেন ইলেকট্রিকের শক দিচ্ছে কেউ—এই অবস্থায়ই দুবাইয়ে থাকা ছোটবেলার বন্ধুকে ফোন দেয়।
তক্ষুনি আবার বখতিয়ারের বানরগুলো তাকে উসকাতে থাকে। সে আর সরল থাকে না। পারফেক্ট খুনির মতো প্রমাণ লোপাট করতে চাকু আর মোবাইল জলে ভাসিয়ে দেয় সে।
যে বখতিয়ার কোনো দিন একটা তেলাপোকাও মারেনি, মুরগি জবাই সহ্য করতে পারে না রক্তের ভয়ে, তাকে এভাবে ফাঁসিয়ে দিল বুলবুলি? মিজানকে ফোন দিয়ে কী বলল আর সে নিজে কীইবা করল? এভাবে শোধ নিল? নিজের প্রাণ নিয়ে এবং প্রেমিককে লটকে দিয়ে? মাথার মধ্যে এসব হাবিজাবি নিয়ে এরপর সে ভিখারির মতো একটা মালগাড়িতে গিয়ে উঠেছিল।
একটা ভাঙাচোরা পুরোনো মোবাইলে নিজের সর্বনাশ যত দেখে, যত শোনে মিজানের চিৎকার, আমি সাক্ষী, আমার কাছে প্রমাণ আছে, ততই তার চোখের চশমা অন্ধ হয়ে যেতে থাকে যেন।
বখতিয়ার ক্রমে শিশিরে কেঁপে উঠতে থাকে, ভীত–হতবিহ্বল বখতিয়ারের কণ্ঠ থেকে গোঁ গোঁ শব্দ হতে থাকে। সে চিৎকার করে কাঁদতে চায়। সান্ধ্য–কার্নিশ থেকে মেহজাবিনের ছায়া মহাদূরের অনন্তে বিলীন হয়ে যায়, বুলবুলি পরির মতো চারপাশে ওড়ে, কখনো সাদা শাড়ি পরে পেত্নির মতো চক্কর খেতে খেতে গান গায়।
বখতিয়ার এসব অবস্থা থেকে লুকাতে মেঝেতে হামাগুড়ি দেয়। বানরগুলো এবার সামনে লাফাতে থাকে। সে স্যান্ডেল হাতে তাদের পেছনে ছুটতে থাকে। এই করে করে বখতিয়ার টেরও পায় না, কখন কপাট খুলে গেছে, কখন পুলিশ তাকে হাতকড়া পরিয়েছে। চারপাশে এত ভিড় কেন? দম আটকে আসতে থাকা বখতিয়ার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে… কাঁদে, বুলবুলিরে আমি না, তোর সাথে আমি কুনোদিন এমুন করতে পারি? তুই অন্তত বিশ্বাস কর, উল্টাপাল্টা যা–ই যখন করছি, আমি করি নাই, আসলে আমার বান্দরগুলো…।
লেখক: কথাসাহিত্যিক।