ইউএনওদের এমন কর্মকাণ্ড কেন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে সবার সামনে ট্রফি ভেঙে এখন সমালোচনার মুখে আছেন বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেহরুবা ইসলাম। তাঁর এই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও বিব্রত।

তবে শুধু আলীকদমের ইউএনও নন, সম্প্রতি আরও কয়েক ইউএনওসহ মাঠ প্রশাসনের কিছু তরুণ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। আর এসব কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো প্রশাসনই সমালোচনার মুখে পড়ছে।

প্রশ্ন উঠেছে, কেন তরুণ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এ রকম কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন কিংবা অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের কয়েকজন বলছেন, প্রশাসনের মোট কর্মকর্তার তুলনায় হয়তো বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করা কর্মকর্তার হার কম। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো ঘটনাগুলো ঘটেই চলছে। তাঁদের অভিমত, এখন তুলনামূলক কম বয়সেই প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইউএনওর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পাচ্ছেন। ফলে অনেকের পরিপক্বতায় ঘাটতি থাকে। অথচ উপজেলা পর্যায়ে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ইউএনওরাই সমন্বয়ের মূল দায়িত্ব পালন করেন।

এখন ইউএনওদের কাজের পরিধিও বেড়েছে। ক্ষমতার দিক দিয়েও পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়েও আকর্ষণীয় পদটি। আবার স্থানীয় পর্যায়ে অনেক প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মানুষকেও মোকাবিলা করতে হয়। ফলে সব মিলিয়ে তরুণ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এ পদের চাপ বা ভার সামলাতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন এবং কেউ কেউ সমস্যা বাধিয়ে ফেলছেন। এ জন্য যাঁরা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়াবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি কেন এগুলো ঘটছে, তা খতিয়ে দেখে ভবিষ্যতে যেন এমন না ঘটে, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক এক ডিসি (বর্তমানে সচিবালয়ে কর্মরত) প্রথম আলোকে বলেন, ইউএনও পদে পদায়নে আরেকটু পরিপক্বতা দেখা উচিত। এখন চাকরিকাল ছয় বছরের মতো হলেই ইউএনও হওয়া যাচ্ছে। অথচ তাঁদের সময়ও ইউএনও হতে চাকরিকাল অন্তত আট বছরের মতো লেগে যেত।

বর্তমানে উপসচিবদের মধ্য থেকে ডিসি করা হয় এবং সিনিয়র সহকারী সচিবদের মধ্য থেকে ইউএনও করা হয়। সচিব থেকে শুরু করে সহকারী সচিব (মাঠ প্রশাসনে সহকারী কমিশনার) পর্যন্ত দেশে এখন প্রশাসনের কর্মকর্তা আছেন ৫ হাজার ৯৭৩ জন। মাঠ প্রশাসনের পদগুলোর মধ্যে জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং ইউএনওর পদটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। প্রতি উপজেলায় একজন ইউএনও থাকেন। দেশে উপজেলা আছে ৪৯২টি।

গত কয়েক দিনের ব্যবধানেই দেশের তিনটি উপজেলার ইউএনওরা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার বান্দরবানের আলীকদমের ইউএনও মেহরুবা ইসলাম ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবার সামনে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের ট্রফি ভেঙে ফেলেন। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এ ঘটনার ঠিক আগের দিন গত বৃহস্পতিবার রাতে বগুড়া সদরের ইউএনও সমর কুমার পালের বিরুদ্ধে এলজিইডির চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। বগুড়া সদর উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে এ ঘটনা ঘটে।

এর আগে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় এসএসসির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় সেখানকার ইউএনও দীপক কুমার দেব শর্মাকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দেওয়া হয়। এ ঘটনায় জড়িত থাকায় সেখানকার একজন কেন্দ্রসচিবসহ কয়েক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া অসদাচরণের দায়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ওই ঘটনায় দিনাজপুর বোর্ডের চারটি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বিতরণ এবং বাছাইয়ের কাজটি হয় ইউএনওদের তত্ত্বাবধানে। তিনি স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের মাধ্যমে কাজটি করে থাকেন। এ জন্য ভূরুঙ্গামারীর ইউএনওর বিরুদ্ধে অবহেলা বা গাফিলতির প্রশ্নটি সামনে এসেছে।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার খারিজ্জমা ইসহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনে ১৫ সেপ্টেম্বর পরীক্ষা শুরুর ৫ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে ৯ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইসমাইল রহমান তাঁদের বহিষ্কার করেন। এ ঘটনায় আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এতে ইসমাইল রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, ৯ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

ঘটনার পৃথক তদন্ত হচ্ছে

আলীকদম উপজেলার ইউএনওসহ সম্প্রতি মাঠ প্রশাসনের যে কজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে, তার প্রতিটি ঘটনার পৃথক তদন্ত হচ্ছে। এখন তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর রোববার এ কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকেরা এসব তদন্ত করছেন। তাঁরা আশা করছেন, আজকের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেতে পারেন।

ঘটনা আগেও ঘটেছে

গত জুলাই মাসে কক্সবাজারের এক সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করার অভিযোগ উঠেছিল টেকনাফ উপজেলার ইউএনও মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে। তীব্র সমালোচনার মুখে অবশেষে তাঁকে প্রত্যাহার করে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা করা হয়।

ওই সময় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিভাগীয় কমিশনারদের সম্মেলনে জোরালোভাবে বলা হয়েছে, তাঁরা যখন জেলায় যাবেন, তখন যেন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে চালচলন আচার-আচরণ বিষয়ে পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেছিলেন, যত বেশি ব্যবস্থাপনার কাজে থাকবেন, ওপরে থাকবেন, তত বেশি মাথা ঠান্ডা করে কথা বলতে হবে।

এর আগে গত বছরের মে মাসে নারায়ণগঞ্জে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে সরকারি ত্রাণ চেয়ে সহযোগিতা চেয়েছিলেন এক ব্যক্তি। কিন্তু ফোন পেয়ে ওই ব্যক্তির বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দিতে যান উপজেলা প্রশাসনের লোকজন। দেখতে পান সহযোগিতা চাওয়া ওই ব্যক্তি চারতলা বাড়ির মালিক। তখন উপজেলা প্রশাসন ফরিদ আহমেদ নামের ওই ব্যক্তিকে শাস্তি হিসেবে ১০০ জনকে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার শাস্তি দেন। কিন্তু পরে জানা যায়, শাস্তির মুখে পড়া ফরিদ আহমেদ চারতলা বাড়ির পুরো মালিক নন। চারতলা বাড়ির মালিক ছয় ভাই ও এক বোন। তিনি বাড়ির মাত্র তিনটি কক্ষের মালিক। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ইউএনও আরিফা জহুরা সমালোচনার মুখে পড়েন।

আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় জামালপুরের এক ডিসিকে শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল। এ ছাড়া মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাংবাদিককে সাজা দেওয়া ও ‘নির্যাতনের’ ঘটনায় কুড়িগ্রামের তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীনসহ তৎকালীন জেলা প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। অবশ্য পরে ডিসিকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

তবে এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়ে যেমন সমালোচনা আছে, তেমনি মাঠ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার ভালো কাজ নিয়ে প্রশংসাও আছে। যেমন রাজশাহীর পবা উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহাদত হোসেন (বর্তমানে উপসচিব) সেবা সহজ করতে চালু করেছিলেন ‘মাটির মায়া’। এ নিয়ে তখন প্রথম আলোয় ‘এসি ল্যান্ডের “মাটির মায়া”’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি। আবার করোনাকালেও মাঠ প্রশাসনের অনেকে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন।

যেমন ২০২০ সালের এপ্রিলে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মারা যান ঝিনাইদহ সদর উপজেলার এক ব্যক্তি। তখন ভয়ে কেউ এগিয়ে এলেন না। এমনকি জানাজা পড়ানোর মতো কেউ এলেন না। তখন ঝিনাইদহ সদরের ইউএনও মো. বদরুদ্দোজা নিজেই তাঁর সঙ্গে থাকা কয়েকজনকে নিয়ে জানাজার ব্যবস্থা করলেন এবং ইমামতি করলেন। এ নিয়ে তখন তিনি গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ ঠেকানোর স্বীকৃতি হিসেবে ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার ২০১৯ পেয়েছিলেন নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার সাবেক ইউএনও ফরিদা ইয়াসমিন।

শৃঙ্খলার বিষয়টি সবাইকে মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে

ইউএনওদের নিয়োগ দেওয়ার সময় উপজেলা প্রশাসন ও উন্নয়নবিষয়ক, ভূমি ব্যবস্থা ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর ও সরকারের সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এখন কেন জানি সমাজের প্রায় সবার মধ্যেই একধরনের অস্থিরতা-অধৈর্য ভাব। এটা আগে ছিল না।

এখন প্রশাসনে শৃঙ্খলাতেও ঘাটতি দেখা যায়। কেউ কাউকে মানতে চান না। পরিমিতিবোধেরও অভাব আছে। তা না হলে যতই রাগ থাকুক, কীভাবে একজন ইউএনও সবার সামনে ট্রফি ভেঙে ফেলেন? কেনইবা একজন ইউএনওর বিরুদ্ধে কর্মচারীদের পেটানোর অভিযোগ উঠবে? আবার প্রশিক্ষণেও দুর্বলতা আছে। তাই শৃঙ্খলার বিষয়টি সবাইকে মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিমিতবোধ থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া মেধা, যোগ্য ও জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী পদোন্নতি এবং পদায়ন করতে হবে।