প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছে সংস্থাটি। তবু ৩০ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বোর্ডে অনুমোদন।
গ্রাহকের কাছে পানি বিক্রি করে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা লাভ করে। অথচ পানির দাম বাড়িয়েই চলেছে। গত এক দশকে ৯ বার পানির দাম বাড়িয়েছে সেবা সংস্থাটি। এবারও আবাসিক গ্রাহকদের জন্য এক লাফে ৩০ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
লাভে থাকা সত্ত্বেও আরেক দফা পানির দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গ্রাহক ও বিশেষজ্ঞরা। গ্রাহকেরা বলছেন, ওয়াসা লোকসানে চললে কথা ছিল। কিন্তু সংস্থাটি প্রতিবছরই পানি বিক্রি করে লাভ করছে। ফলে পানির দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের কাঁধে আরও চাপ সৃষ্টি করার যৌক্তিকতা নেই।
বর্তমানে আবাসিক বাসাবাড়ির গ্রাহকেরা এক হাজার লিটার পানি ১৮ টাকায় পাচ্ছেন। বাণিজ্যিক বা অনাবাসিক গ্রাহকেরা একই পরিমাণ পানির জন্য ওয়াসাকে দিচ্ছেন ৩৭ টাকা। অথচ রাজধানী শহরের আবাসিক গ্রাহকেরা ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে এক হাজার লিটার পানি কিনছেন ১৫ টাকা দরে। অর্থাৎ ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে ওয়াসার পানির দাম বেশি।
ঢাকা ওয়াসা এক হাজার লিটার পানি ১৫ টাকায় সরবরাহ করছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা নিচ্ছে ১৮ টাকা। এখন আবার দাম বাড়াতে চায়, এটা সমর্থন করা যায় না।মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান, ডিন, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ যৌক্তিক নয় বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা এক হাজার লিটার পানি ১৫ টাকায় সরবরাহ করছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা নিচ্ছে ১৮ টাকা। এখন আবার দাম বাড়াতে চায়, এটা সমর্থন করা যায় না। তিনি বলেন, অবৈধ সংযোগ ও চুরির কারণে অনেক পানি নষ্ট হচ্ছে। দুর্নীতি ও অপচয় না কমিয়ে গ্রাহকের কাঁধে দামের বোঝা চাপানো উচিত নয়।
দাম বাড়ানোর সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে গত ২৭ মার্চ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছে, আবাসিকে ৩০ শতাংশ ও বাণিজ্যিকে ৫০ শতাংশ পানির দাম বাড়ানো যেতে পারে। এই প্রতিবেদন বোর্ডে অনুমোদন হয়ে এখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
সম্প্রতি পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পানি
পরিশোধনে ব্যবহৃত রাসায়নিক, বিদ্যুৎ বিল, জনবলের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ছাড়া পানি সরবরাহে ঋণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। তাই পানির উৎপাদন খরচ এখন বেড়ে গেছে।
বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগ ৭ হাজার ৭৬৭টি। নগরের প্রায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়।
১৮ টাকায় (এক হাজার লিটার) পানি বিক্রি করেও ওয়াসা লাভে আছে। ফলে নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারিগরি অপচয় কমিয়ে আনা গেলে সে টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যেত।এস এম নাজের হোসাইন, সহসভাপতি, ক্যাব
পাঁচ অর্থবছরে যত লাভ
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী সংস্থার নিট মুনাফা বা লাভ ছিল ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৮ কোটি ৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরে ২১ কোটি ১৯ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৯ কোটি ৮৪ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬১ কোটি ৯৩ লাখ নিট মুনাফার হিসাব দেওয়া হয়েছে ওয়াসার বাজেট প্রতিবেদনে।
ওয়াসার পানি নিয়মিত আসে না। অনেক সময় পানিতে ময়লা পাওয়া যায়। বর্তমানে যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও লবণাক্ত। ফলে মান না বাড়িয়ে দাম বাড়ানোর দিকেই ঝোঁক ওয়াসার।হালিশহর সরাইপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী ইমাম
ওয়াসার এক নথিতে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০৮ কোটি ৫৪ লাখ ৯ হাজার টাকা, মোট রাজস্ব ব্যয় ২৪৯ কোটি ৪৩ লাখ। ফলে সংশোধিত বাজেটে মোট লাভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ কোটি ১০ লাখ টাকা।
অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রাক্কলনে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩৪৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। মোট রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭০ কোটি ৪ লাখ টাকা। ফলে প্রাক্কলিত বাজেটে মোট লাভের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৭৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। নিট লাভের পরিমাণ ১১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
লাভে থাকায় সংস্থাটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎসাহ বোনাস বা প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগও নিয়েছে। গত বছর নিয়মিত বেতন-ভাতার বাইরে দুটি করে মূল বেতন বিশেষ পুরস্কার হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
গত এক দশকে ৯ বার পানির দাম বাড়িয়েছে সেবা সংস্থাটি। এবারও আবাসিক গ্রাহকদের জন্য এক লাফে ৩০ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন
পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রায় প্রতিবছরই সমালোচনার মুখে পড়ে ওয়াসা। গ্রাহকেরা পানির মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রায় পাঁচ বছর ধরে গরম এলে পানির উৎপাদন কমে যায়। পানি যতটুকু আসে, ততটুকুও লবণাক্ত। বাধ্য হয়ে গ্রাহকদের কেনা পানি পান করতে হয়। এ বছর ১০ মার্চ থেকে উৎপাদন এক ধাক্কায় ৭ থেকে ৮ কোটি লিটার কমে যায়। বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, নিয়মিত পানি পাচ্ছেন না তাঁরা।
লবণাক্ততার জন্য হালিশহর, উত্তর ও দক্ষিণ পতেঙ্গা, কাটগড়, বাকলিয়া, কর্নেলহাট, আকবর শাহ, পাহাড়তলীসহ একাধিক এলাকায় সংকট তৈরি হয়েছে।
হালিশহর সরাইপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার পানি নিয়মিত আসে না। অনেক সময় পানিতে ময়লা পাওয়া যায়। বর্তমানে যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও লবণাক্ত। ফলে মান না বাড়িয়ে দাম বাড়ানোর দিকেই ঝোঁক ওয়াসার।
উত্তর কাট্টলীর ঈশান মহাজন সড়কের আরেক বাসিন্দা শাহেদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় প্রতিবছরই ওয়াসা পানির দাম বাড়ায়। মাঝখানে ২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে পানির দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এরপরের বছরই দুই দফা দাম বাড়ানো হয়েছে। পানির দাম বাড়লেও সেবা বাড়েনি। এখনো তাঁর এলাকায় নিয়মিত পানি যায় না। অথচ এসব দেখার কেউ নেই।
পানিসংকটের বিষয়ে ওয়াসার এমডি প্রথম আলোকে বলেন, দূরবর্তী এলাকাগুলোতে পানির কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে না। কাপ্তাই হ্রদে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। এ কারণে উৎপাদন এক ধাক্কায় ৭ থেকে ৮ কোটি লিটার কমেছে।
লাভে থেকেও আরেক দফা দাম বাড়ানো অযৌক্তিক বলে মনে করেন ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ টাকায় (এক হাজার লিটার) পানি বিক্রি করেও ওয়াসা লাভে আছে। ফলে নতুন করে পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কারিগরি অপচয় কমিয়ে আনা গেলে সে টাকায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যেত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি অপচয় কমাতে এখনো সক্ষমতা অর্জন করেনি। এ ছাড়া অবৈধ সংযোগ, পানি চুরির নানা অনিয়ম তো আছেই।