বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে যাঁদের লিবিয়া নেওয়া হয়েছে, তাঁদের ৬৩ শতাংশই বন্দী হয়েছেন এবং অধিকাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ৫৫৭ জন বাংলাদেশির যাত্রা, গন্তব্য, অর্থ, নিপীড়ন, উদ্ধার থেকে শুরু করে প্রত্যেকের ৫০ ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। আজ শুক্রবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ব্র্যাক গবেষণার এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। ৫৪ শতাংশই বলেছেন, তাঁরা কখনো তিন বেলা খাবার পাননি। অন্তত ২২ শতাংশ দিনে মাত্র এক বেলা খাবার পেয়েছেন। যাঁরা বন্দী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন আর ৭৯ শতাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
গবেষণায় উঠে আসা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ব্র্যাক বলছে, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে যাঁদের লিবিয়া নেওয়া হয়, তাঁদের সবাইকে ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলা হয়। তবে তাঁরা আর চাকরি পান না। অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে অর্থ। তবে এত কিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার প্রবণতা থামছে না।
ব্র্যাক বলছে, এক দশক ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়া লোকজনের মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে। প্রায়ই এভাবে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত নানা দেশের ২৫ লাখ মানুষ এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গেছেন। এভাবে যেতে গিয়ে প্রায় ২২ হাজার মানুষ সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অনেক বাংলাদেশি আছেন।
ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার পথটি বেছে নেন। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই পথে অন্তত ৭০ হাজার ৯০৬ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১৫ তারিখ লিবিয়া থেকে এভাবে যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে ৯ বাংলাদেশি প্রাণ হারান। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২৬ বাংলাদেশিকে। তবে এরপরও এমন যাত্রা থামছে না। গতকাল বৃহস্পতিবারও লিবিয়া থেকে ১৪৪ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন।
ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোক সবচেয়ে বেশি। তাঁদের বেশির ভাগেরই বাড়ি মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা জেলায়।
লিবিয়াফেরত ৫৫৭ বাংলাদেশির তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের ৬০ শতাংশের পরিবারকে স্থানীয় দালালেরা ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ শতাংশই চাকরির বা কোনো কাজ পাননি। উল্টো নানা ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছেন।
যাত্রাপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই-মিসর হয়ে লিবিয়া গেছেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। এ ছাড়া ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল-দুবাই হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে দুবাই-সিরিয়া হয়ে লিবিয়া এবং অল্প কিছু লোক ঢাকা থেকে সরাসরি লিবিয়া গেছেন।
লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার জন্য অর্থ কোথায় পেয়েছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে ৫৬ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা নিজেরাই এই টাকা জোগাড় করেছেন। ২৩ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা পরিবারের কাছ থেকে অর্থসহায়তা নিয়েছেন।
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান (মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) বলেন, সাধারণ মানুষ ও বিদেশগামীদের সবার আগে সচেতন হতে হবে। এলাকার স্থানীয় দালাল ও মানব পাচার চক্রকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে। বিশেষ করে অর্থের লেনদেন খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি লিবিয়া বা অন্যান্য দেশে থাকা আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে।