অধ্যাপক নুরুল ইসলাম

আমার অর্থনীতিবিদ হয়ে ওঠা

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আর নেই। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি শিক্ষকতা করেছেন, জড়িত ছিলেন বহু ধরনের গবেষণায়। ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি বিশেষ প্রকাশনায় তাঁর ইংরেজি এই আত্মস্মৃতি ছাপা হয়েছিল। ত্রৈমাসিক প্রতিচিন্তায় ২০১৮ সালের ১৭ মে সংখ্যায় এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছেন খলিলউল্লাহ্। আজ লেখাটির প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হলো—

নুরুল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়জীবন

হার্ভার্ড থেকে অর্থনীতির ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন শেষে ১৯৫৫ সালের মধ্যভাগে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। অর্থনীতি বিভাগকে তখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমত, যোগ্য শিক্ষকের প্রচণ্ড অভাব। কারণ, বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, যাঁরা হিন্দু ছিলেন, তাঁরা ১৯৪৭ সাল এবং তার পরপরেই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, পুরোনো পাঠ্যসূচি, যেখানে অর্থনীতিবিষয়ক সাম্প্রতিক জ্ঞানের শাখাগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

আমার প্রথম কাজ ছিল পাঠ্যসূচিকে আধুনিকায়ন করা। আমি সেটা ব্যাপক আকারেই করেছিলাম, বিশেষ করে অর্থনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে (ব্যষ্টিক, সামষ্টিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য)। জ্যেষ্ঠ শিক্ষক না থাকায় বিএ সম্মান ও এমএ স্নাতকোত্তর উভয় শ্রেণিতেই প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা একটানা পড়াতে হতো। এর মধ্যেই আমাকে পাঠ্যসূচি আধুনিকায়নের কাজ করতে হয়েছিল।

সে সময় পড়ানোর দায়িত্ব খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হতো এবং শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ছোট দলে ছাত্রছাত্রীদের টিউটরিয়াল ক্লাসও নিতে হতো। ছাত্রছাত্রীদের কাছে একজন শিক্ষকের বিধিসম্মত নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে এই কাজকে বিবেচনা করা হতো।

একইভাবে গবেষণায় যুক্ত হওয়াটা তখনকার দিনে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হতো। বেশির ভাগ শিক্ষকই, বিশেষ করে তরুণ ও উচ্চ প্রশিক্ষিতরা, অল্পবিস্তর গবেষণাকে তাঁদের বাধ্যবাধকতা বলেই মনে করতেন। শিক্ষকদের এসব গবেষণা প্রকাশের একটা জায়গা ছিল পাকিস্তান অর্থনৈতিক জার্নাল (পাকিস্তান ইকোনমিক জার্নাল)। পাকিস্তান অর্থনীতি সমিতি এটা প্রকাশ করত। এর সম্পাদকীয় কার্যালয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ। পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্যেষ্ঠ ও সুপরিচিত শিক্ষকেরা এর সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

যদিও আমাদের বিভাগে বিদ্যমান বিদ্যায়তনিক পরিবেশে আমার আগ্রহ ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর, কিন্তু গবেষণার ধারণা ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা বা আন্তযোগাযোগ করার মতো সমমনা গ্রুপ না থাকায় আমি ভাবলাম জাতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে কাজ করব, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে। আমার কিছু সহকর্মী ছিলেন, যাঁরা গ্রামীণ অর্থনৈতিক জরিপ পরিচালনা করেছিলেন।

সেসব জরিপে সংগৃহীত উপাত্ত নিয়ে আমি গবেষণা শুরু করার এবং পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামীণ অর্থনীতি-সম্পর্কিত নির্দিষ্ট অনুমানগুলোকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আসলে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ চাচ্ছিলাম। যথারীতি আমি জরিপে অংশ নিলাম এবং এটা করতে গিয়ে গ্রামের কৃষক-ব্যবসায়ী ইত্যাদির সাক্ষাত্কার নিলাম। এর ফলে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত পরিচিতি ও জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়। গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল পাটের উত্পাদন ও বাজারজাতকরণ থেকে শুরু করে গ্রামীণ ঋণ ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান।

যেসব প্রশ্ন গবেষণা করে দেখা হয়েছে, তার মধ্যে সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিযোগিতা বা অন্যথা যা হতে পারে, তার মাত্রাসহ কাঁচা পাটের বাজারজাতকরণ চেইনের কাঠামো; ছদ্ম গ্রামীণ বেকারত্ব বা অনুন্নয়নের ধারণা বিশ্লেষণ; গ্রামীণ পরিবারগুলোর ঋণের উত্স এবং তার ব্যবহার। আমি জেনেছিলাম যে সাধারণভাবে যাদের উত্স মনে করা হয়, সেই গ্রামীণ মহাজনেরা ঋণের প্রধান উত্স নয়, বরং বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য সম্পর্ক এবং নিজের সঞ্চয় ছিল প্রধান উত্স।

আবার আমাকে বলা হয়েছিল, যখন ধান উত্পাদন বেশি লাভজনক ছিল, তখনো কৃষকেরা পাট উত্পাদন করছিলেন। কারণ, পাটের বাজারমূল্যের ব্যাপক ওঠানামার ফলে একটি পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যে পরিমাণ চাল দরকার ছিল, তা পাট বিক্রি করে চাল কেনার মাধ্যমে নিশ্চিত হতো না। অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদাহরণের মাধ্যমে এ ধরনের ধাঁধা ভালোভাবে বোঝা যাবে।

১৯৫০-এর দশকের শেষ ভাগে এবং ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে পাকিস্তান সরকার আমাকে পূর্ব-পশ্চিম অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে বেশ কিছু কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়। আন্ত-অঞ্চল সম্পদ বরাদ্দের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে একজন একাডেমিকের জন্য এটা বেশ চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা ছিল।

এর উদ্দেশ্য ছিল কর ও করবহির্ভূত সম্পদ এবং বিদেশি সাহায্য থেকে পাকিস্তান সরকারের অর্জিত আয় পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে আয়বৈষম্য কমানোর উদ্দেশ্যে দুই অঞ্চলের মধ্যে বণ্টন করা। কমিশনে এ বিষয়ে বিস্তর বিতর্ক ছিল। প্রথমত, আয়বৈষম্য কীভাবে পরিমাপ করা হবে এবং দ্বিতীয়ত, আয়বৈষম্যের ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের প্রভাব কীভাবে পরিমাপ করা হবে। প্রথম বিষয়কে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত আলোচনা হয় এবং বলা হয় বৈষম্যের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য কোন অঞ্চলের আয়কে ভিত্তি ধরা হবে? পূর্বের, না পশ্চিমের?

স্পষ্টতই, যেহেতু পশ্চিমের আয় বেশি ছিল, তাই এটাকে ভিত্তি ধরলে পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের আয়ের যে ঘাটতি, তার শতাংশ কম আসবে। কিন্তু যদি পূর্বের আয়কে ভিত্তি ধরা হয়, তাহলে পূর্বের চেয়ে পশ্চিমের আয় উদ্বৃত্ত বেশি আসবে। কমিশনে পশ্চিমের সদস্যরা প্রথম পদ্ধতিকে নিতে চাচ্ছিল। কারণ, এতে জনগণের কাছে বৈষম্য কম বলে প্রমাণ করা যাবে।

বিকল্প হিসেবে তারা চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে সমগ্র পাকিস্তানের আয়ের গড় উদ্বৃত্ত পরিমাণ দিয়ে বৈষম্য পরিমাপ করতে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আয়ের উদ্বৃত্ত শতাংশ স্বাভাবিকের চেয়ে কম মনে হবে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে তিন ধরনের পদ্ধতিই কমিশনের প্রতিবেদনে দেওয়া হবে। বর্তমান সময়ে এই বিতর্ক অর্থনৈতিক যুক্তির বিচারে হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু এখানে রাজনীতিটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, পশ্চিমের সদস্যরা জনগণের কাছে বৈষম্যের পরিমাণ যতটুকু সম্ভব কম দেখাতে চাচ্ছিলেন।

দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত সম্পদ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সক্ষমতা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক ছিল। বিদেশি সাহায্য কাজে লাগানো বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা নিয়ে এই বিতর্ক এখনো রয়ে গেছে। তখন সিদ্ধান্ত হলো যে সম্পদ কাজে লাগানোর সক্ষমতা তার ব্যবহার থেকে আলাদা নয়। যদি সক্ষমতা কম থেকেও থাকে, তাহলে সেটা অতিরিক্ত সম্পদ দিয়ে বাড়ানো যাবে।

স্বাধীনতা-উত্তর পরিকল্পনা কমিশনে যখন আমি আর্থিক ব্যবস্থা ও বাজেট-প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন এই অভিজ্ঞতা খুবই কাজে লেগেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এ সময়ে আমি পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত কিছু বৃহদাকার শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ায় যুক্ত ছিলাম। এ জন্য আমাকে সর্বনিম্ন মজুরির অর্থনীতির ওপর পড়াশোনা করতে হয়েছিল এবং কিছু উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নিতে হয়েছিল।

সে সময় অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে গাণিতিক ও পরিসংখ্যানগত পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অর্থনীতিতে রৈখিক প্রোগ্রামিং তখন ছিল সময়ের উন্মাদনা। ম্যাট্রিক্স বীজগণিতের কোনো জ্ঞানই আমার ছিল না।

পরিসংখ্যান বিভাগের আমার এক সহকর্মীকে অনুরোধ করেছিলাম, সে যেন আমাকে ম্যাট্রিক্স বীজগণিত শেখায়। সাম্প্রতিক সংযোজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার আগ্রহের কারণে আমি নুফিল্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পেয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। প্রথমে যাই লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে। সেখানে ম্যাট্রিক্স বীজগণিতের ওপর দখল নেওয়া এবং অর্থনীতিতে রৈখিক প্রোগ্রামিংয়ের ওপর প্রথম শ্রেণির রচয়িতা স্যামুয়েলসন, সলো ও ডর্ফম্যানের লেখা পড়ার চেষ্টা করি।

তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়োগিক অর্থনীতি বিভাগের দিকে এগোই এবং অধ্যাপক রিচার্ড স্টোনের সংস্পর্শে এসে জাতীয় আয় হিসাবরক্ষণ বিষয়ে সাম্প্রতিক সংযোজন ও পরিশোধনের সঙ্গে নিজের পরিচিতি ঘটাই। রিচার্ড স্টোন ছিলেন তখনকার সময়ে জাতীয় আয় হিসাবরক্ষণ বিষয়ে নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত।

লন্ডনে আমি শিক্ষকদের জন্য আয়োজিত লিওনেল রবিনসের উচ্চতর সেমিনারে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। এটা অর্থনীতির শিক্ষকদের জন্য আয়োজন করা হতো। লিওনেল রবিনস ছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের দীর্ঘদিনের পরিচালক। অর্থনীতির প্রকৃতি ও তাত্পর্যের ওপর সুবিখ্যাত গ্রন্থেরও তিনি রচয়িতা।

যুক্তরাজ্যে থাকার পর আমি নেদারল্যান্ডস ইকোনমিক ইনস্টিটিউটে (এনইআই) কয়েক মাস কাটাতে চলে যাই। জ্যান টিনবারজেনের গবেষণা সেমিনারে অর্থনৈতিক নীতিতত্ত্ব বিষয়ে সে সময় ব্যাপক আলোচনা হতো, যে বিষয়ে টিনবারজেন নেতৃস্থানীয় অবদান রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক।

তিনি পরবর্তী সময়ে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। অর্থনৈতিক নীতির লক্ষ্য ও বাস্তবায়নপন্থার মধ্যে সম্পর্কের সব কটি দিক নিয়ে যে কয়জন অনাবাসিক ফেলো বাগ্‌বিতণ্ডা করেছিলেন, আমি ছিলাম তাঁদের মধ্যে একজন। এই ইনস্টিটিউটে থাকাকালেই আমি পাকিস্তান অর্থনীতির জন্য স্বল্পমেয়াদি ইকোনমেট্রিকের ওপর বই লেখা সম্পন্ন করি।