জন্ম থেকেই দুই হাত নেই মিরাজুল ইসলামের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তিনি ‘মিরাজ আফ্রিদি’ নামে পরিচিত। স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার ও একজন সহকারীর সহায়তায় তিনি দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া নানা বিষয় নিয়ে ভ্লগ (ভিডিও ব্লগ) করেন। আর এতে তাঁর মাসে আয় হয় গড়ে ৫০ হাজার টাকা। কোনো কোনো মাসে লাখ টাকাও আয় হয়। মিরাজের ফেসবুক পেজে ফলোয়ারের (অনুসারী) সংখ্যা ১২ লাখ।
২৩ বছরের বয়সী মিরাজের বাড়ি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের যাত্রাপুর গ্রামে। তিনি স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন।
মিরাজুল দুই পা দিয়ে লিখতে পারেন। চামচ দিয়ে খাওয়া, এমনকি রান্নাও করতে পারেন। ভ্লগ করাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এই আয় দিয়েই বাবা তোরাব আলী, স্ত্রী সুমাইয়া আক্তার, এক বছর দুই মাস বয়সী মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা ও নিজের খরচ চালাচ্ছেন।
২০১৯ সাল থেকে ফেসবুকে ভ্লগ শুরু করার পর আয় নিয়ে আর ভাবতে হয়নি। তাঁর ফেসবুক পেজটি ভেরিফায়েড। মিরাজুল এখন বেশ গর্ব করেই বলেন, তিনি এখন আর কারও ওপর নির্ভরশীল নন, বরং তাঁর আয় দিয়েই সংসার চালাতে পারছেন।
মিরাজুলের কৃষক বাবা স্ট্রোক করার পর ছয় বছর ধরে কোনো কাজ করতে পারেন না। মিরাজুলের বড় ভাই বাবার ওষুধ কেনাসহ কিছু খরচ দেন। এ ছাড়া অন্য সব খরচ মিরাজুলই সামলাচ্ছেন। মা সূর্য খাতুন মারা গেছেন দুই বছর আগে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট মিরাজুল। এক বোনের বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৪ বছর আগে।
২০১৯ সাল থেকে ফেসবুকে ভ্লগ শুরু করার পর আয় নিয়ে আর ভাবতে হয়নি। তাঁর ফেসবুক পেজটি ব্লু ভেরিফায়েড। মিরাজুল এখন বেশ গর্ব করেই বলেন, তিনি এখন আর কারও ওপর নির্ভরশীল নন, বরং তাঁর আয় দিয়েই সংসার চালাতে পারছেন।
মুঠোফোনে কথা হয় মিরাজুলের সঙ্গে। ফেসবুক পেজে তাঁর পোস্ট করা ভিডিও বা ভ্লগগুলোর লাখ লাখ ভিউ হচ্ছে। তবে মিরাজুল বলেছেন, ফেসবুক পোস্টের রিচ (মানুষের কাছে কম পৌঁছানো) কমিয়ে দেওয়ায় বর্তমানে ভিউ ও আয় কিছুটা কমেছে।
ফেসবুকে মিরাজুলের পেজে গিয়ে দেখা গেল, তিনি বেশির ভাগ সময় স্ত্রী ও মেয়ের সঙ্গে দৈনন্দিন কাজগুলোই ভ্লগে তুলে ধরছেন। বাবা বা শ্বশুরবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে ভ্লগগুলো করেন তিনি।
মিরাজুল বললেন, বিভিন্নজন তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে উপহার পাঠান। উপহার পাঠিয়ে অনেকে ওই পণ্য সম্পর্কে ভ্লগে কিছু বলার অনুরোধ করেন। তখন ওই পণ্যগুলো ধরেও ভ্লগ করেন। তবে এ জন্য আলাদা সম্মানী নেন না। এর বাইরে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান মাঝেমধ্যে স্পনসর করে। তিনি জানালেন, কোন বিষয়ে ভ্লগ করবেন, তা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে স্ক্রিপ্ট লেখেন। আবার মাঝেমধ্যে কোথাও বেড়াতে গেলে বা তাৎক্ষণিক কোনো কিছু নিয়েও ভ্লগ করেন।
‘বাবার বাড়ি ছাড়া বলতে গেলে আমাদের আর কোনো সম্পত্তি নেই। আমি আমার নিজের আয় থেকে যা করার করছি। গ্রামের অসহায় শিশুদের বিনা মূল্যে পড়ানোর জন্য তিনজন মিলে একটি এতিমখানা চালু করেছিলাম, এই এতিমখানার শিক্ষকদের বেতনও দিচ্ছি।’(মিরাজুল ইসলাম, ভ্লগার)
মিরাজুল তাঁর পায়ের সাহায্যে মাছ রান্না করে তাঁর স্ত্রীকে খাওয়াচ্ছেন, এমন একটি ভ্লগে ভিউ হয়েছে এক কোটি। স্ত্রীকে নিয়ে আরেকটা ভ্লগ ‘অবশেষে ক্যামেরার সামনে?’, এটির ভিউ হয়েছে ৫৪ লাখ। বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিলেন, এর ভিউ হয়েছে ৫ দশমিক ২ মিলিয়ন। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে নিজে নিজে পায়ের সাহায্যে আস্ত মুরগি খাওয়া ভ্লগের ভিউ ৬০ লাখের বেশি, এমনকি মেয়ের বাবা হওয়ার পর তা নিয়ে করা ভ্লগের ভিউ হয়েছে এক কোটির বেশি।
এ ছাড়া রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভিজ্ঞতা, টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে যাওয়া বা স্ত্রীকে শাড়ি কিনে দেওয়া, মেয়ের জন্মদিন, বাবা হঠাৎ কেন কান্না করছেন, পাসপোর্ট করতে দালালকে ঘুষ দিতে হয়েছিল কি না, বর্ষার পানিতে পা দিয়ে মাছ ধরা, হেলিকপ্টারে চড়াবেন বলে স্ত্রীর হাতে খেলনা হেলিকপ্টার ধরিয়ে দেওয়া—এমন সব বিষয় নিয়ে ভ্লগ করেছেন এই তরুণ।
মিরাজুল বললেন, ‘বাবার বাড়ি ছাড়া বলতে গেলে আমাদের আর কোনো সম্পত্তি নেই। আমি আমার নিজের আয় থেকে যা করার করছি। গ্রামের অসহায় শিশুদের বিনা মূল্যে পড়ানোর জন্য তিনজন মিলে একটি এতিমখানা চালু করেছিলাম, এই এতিমখানার শিক্ষকদের বেতনও দিচ্ছি।’
দুই হাত না থাকায় ছোটবেলা থেকেই অনেক অবহেলার শিকার হয়েছেন বলে জানান মিরাজুল। তিনি বলেন, অনেকে ভিক্ষা করারও পরামর্শ দিতেন। তবে পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে তাঁর মা সব সময় পাশে ছিলেন। মা ভালো কাজ করার পরামর্শ দিতেন সব সময়। যেসব মানুষ একসময় অবজ্ঞা–অবহেলা করতেন, এখন তাঁরাই তাঁর কাজ দেখে প্রশংসা করেন।
বিয়ের আগে ভ্লগ দেখেই সুমাইয়া ফেসবুকে মিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। দুই হাত না থাকার পরও সুমাইয়া কেন পরিবারের অমতে গিয়ে বিয়ে করলেন, এ নিয়েও একটি ভ্লগ আছে। সেখানে সুমাইয়া বলেছেন, মিরাজকে দেখে তাঁর মায়া হয়েছে। মনে হয়েছে মিরাজের দুই হাত না থাকলেও তাঁর নিজের তো দুই হাত আছে। আর স্বামী ও সন্তান নিয়ে এখন সুমাইয়া খুব সুখে আছেন বলেও জানিয়েছেন।
দুই হাত না থাকার যে কষ্ট, তা–ও বিভিন্ন ভ্লগে তুলে ধরেছেন মিরাজুল। মেয়ে বাবার কাঁধে ও কোলে চড়তে চায়। কিন্তু দুই হাত না থাকায় তা করতে পারেন না। একটি ভ্লগে দেখা গেল, ঝুঁকি নিয়েই মিরাজুল মেয়েকে কাঁধে বসিয়ে ঘুরছেন। মেয়ে যখন আরও ছোট ছিল, তখন তিনি বিছানায় শুয়ে দুই পা দিয়েই ওপরে তুলে আদর করতেন। ভ্লগে মিরাজ তাঁর আক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, মেয়ে তো আর বুঝতে পারে না তার বাবার দুই হাত নেই।
অন্য পেশায় না গিয়ে ভ্লগ করাকে কেন পেশা হিসেবে বেছে নিলেন, এ প্রসঙ্গে মিরাজুল বললেন, দুই হাত থাকার পরও অনেকে চাকরি পাচ্ছেন না। সেই জায়গায় তাঁর তো দুই হাত নেই। তাই চাকরি করার চেষ্টা করেননি। তাঁর করা ভ্লগগুলো মানুষ পছন্দ করছেন, দেখছেন। তাই এটাকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
মিরাজুল পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে পছন্দ করেন, তাই কষ্ট হলেও পাহাড়ে বেড়াতে যান। তিনি মনে করেন, সফলতার সিঁড়ি অতিক্রম করতে গেলে বাধা আসবেই, এসব বাধা অতিক্রম করেই সফল হতে হবে।