ভুয়া রোগীর কাগজপত্র তৈরি করছেন ফরহাদ হোসেন
ভুয়া রোগীর কাগজপত্র তৈরি করছেন ফরহাদ হোসেন

সমাজকল্যাণমন্ত্রীর এলাকা

ভুয়া রোগী বানিয়ে অর্থ আত্মসাতে মন্ত্রীঘনিষ্ঠরা

লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের কাশিরাম গ্রামের মুন্সিপাড়ার সহিদার রহমান, তাঁর মা নৈতানী খাতুন, স্ত্রী আবিদা খাতুন, ছোট ভাই সফিয়ারের স্ত্রী মহিলা খাতুন ৫০ হাজার টাকা করে সরকারের চিকিৎসা সহায়তা পেয়েছেন। কিন্তু যে জটিল ছয় রোগের জন্য সরকার চিকিৎসা সহায়তা দেয়, তাঁদের সেই রোগ নেই।

মূলত ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদ্‌রোগ ও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত গরিব রোগীদের আর্থিক সহায়তা দেয় সরকার। আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির যোগ্যতা ও শর্তাবলিতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট রোগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও টেস্ট রিপোর্ট অবশ্যই থাকতে হবে। তাঁদের এসব রোগ নেই। কিন্তু কাগজে তাঁদের এমন রোগী দেখানো হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের ভাষ্যমতে, ২০১৯ সালে নুরুজ্জামান আহমেদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁর নির্বাচনী এলাকা লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলায় ভুয়া রোগী বানানোর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রায় চার বছরে এই দুই উপজেলায় এখন ক্যানসার, কিডনিসহ জটিল ছয় রোগের ভুয়া রোগীর ছড়াছড়ি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, কালীগঞ্জ ও আদিতমারীর ১৬ ইউনিয়নে এমন ভুয়া রোগীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।

প্রথম আলো কালীগঞ্জের ৫টি ও আদিতমারীর ৩টি গ্রামে অনুসন্ধান করে ২৪৫ জন ভুয়া রোগীর খোঁজ পেয়েছে। সরেজমিনে অনুসন্ধান করা গ্রামগুলো হলো কালীগঞ্জের কাশিরাম, বৈরাতি, আমিনগঞ্জ, কাঞ্চনশ্বর, শ্রুতিধর এবং আদিতমারীর মহিশখোঁচার কদমতলা, পলাশীর তালুক পলাশী ও দুর্গাপুরের উত্তর ও দক্ষিণ বোগদা।

আর্থিক সহায়তা পাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগ কিডনি, ক্যানসার ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে দাবি করেন। তবে ওই গ্রামগুলো ঘুরে শতকরা ১০ জনও এমন রোগী পাওয়া যায়নি।

প্রথম আলো প্রতিবেদক তাঁর সফরসঙ্গী সাইফুল ইসলামের নামে এ ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে নেন

যে বরাদ্দে লুটপাট

প্রতিবছর সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় জটিল ছয় রোগের চিকিৎসা সহায়তার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়। সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুসারে, বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ জেলা সমাজসেবা কার্যালয় নির্বাচিত প্রত্যেক রোগীকে এককালীন ৫০ হাজার টাকা প্রদান করে। ২৫ শতাংশ সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের জন্য সংরক্ষিত।

সমাজসেবা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, সংরক্ষিত ২৫ শতাংশ বরাদ্দ এসব রোগের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ও মন্ত্রণালয়ে প্রাপ্ত আবেদনগুলোর অনুকূলে রোগীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। সংরক্ষিত বরাদ্দ থেকে ভুয়া রোগীদের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে এই লুটপাট হচ্ছে।

কাজেই মন্ত্রীসহ অন্য যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা অপরিহার্য ও দৃষ্টান্তমূলকভাবে এটা করা উচিত।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (চিকিৎসা সহায়তা শাখা) কামাল হোসেন মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত যাচাই-বাছাই ও বাস্তবায়ন কমিটিরও সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কমিটিতে সচিবালয় ক্লিনিকের সিভিল সার্জন বা তাঁর প্রতিনিধি চিকিৎসক থাকেন। কমিটি অনুমোদন করে যে তালিকা পাঠায়, সেই তালিকা ধরে চেক বিতরণ করা হয়। ভুয়া রোগীর বিষয়টি কমিটির সভাপতি ও সদস্যসচিব বলতে পারবেন।

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে উল্লেখিত ছয়টি রোগে আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা দিতে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত ২৫ শতাংশ (৩৭ কোটি ৫০ লাখ) বরাদ্দের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৯১ লাখ এবং ৬ হাজার ৭১৮ রোগীকে ৩৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

ঘরে ঘরে ‘ভুয়া’ রোগী

কালীগঞ্জের কাশিরাম গ্রামে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বাড়ি। এই গ্রামে কাজীটারী গুরাতিপাড়া, জাফরটারী, উত্তর ঘনেশ্যাম, পাইকানটারী, মদনপুর বৈরাতিপাড়া ও পার্শ্ববর্তী শ্রুতিধর গ্রামে খোঁজ নিয়ে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ভুয়া রোগীর তথ্য পাওয়া গেছে।

উত্তর ঘনেশ্যামের মোহাম্মদ আলী সুস্থ হয়েও ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন। তিনি নিজেকে ক্যানসার রোগী দাবি করেছেন। তবে কোথায় তাঁর চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার হয়েছে বলতে পারেননি। প্রতিবেশীরা জানান, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। কালীগঞ্জের বটতলাতে পানের দোকান করেন।

জাহাঙ্গীর আলমকে স্ট্রোকে প্যারালাইজড রোগী বানিয়ে ৫০ হাজার টাকা তুলে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছে দালাল চক্র

মন্ত্রীর বাড়ির আশপাশে থানাপাড়া ও বাসস্ট্যান্ড এলাকার অন্তত ২০ জন জটিল রোগী সেজে টাকা পেয়েছেন। নওয়াব আলী ও বাদশা মিয়া দুই ভাই। তাঁরা দুজনই ৫০ হাজার করে তিনবার মোট ৩ লাখ টাকা পেয়েছেন। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাঁরা দুজনই সুস্থ।

১ নভেম্বর বাদশা মিয়া ও নওয়াব আলীর সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে কথা হয়। বাদশা জানান, তিনি তিন বছর আগে রংপুরের একটি হাসপাতালে পিত্তথলির অপারেশন করেছিলেন। নওয়াব আলী ডায়াবেটিসে ভুগছেন বলে দাবি করেন।

কালীগঞ্জের স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, সমাজকল্যাণমন্ত্রী প্রথম দিকে নিজেই এসব ভুয়া রোগীকে চিকিৎসা সহায়তার চেক বিতরণ করতেন। এখন বিভিন্ন ইউনিয়নে তাঁর আস্থাভাজন দলীয় নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে চেক বিতরণ করেন।
কালীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রেফাজ উদ্দিন মন্ত্রীর হয়ে কাশিরামে চেক বিতরণ করেন। তিনিও স্বীকার করেছেন, অনেকে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে চেক নিয়েছেন।

জানতে চাইলে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রোগীরা দরখাস্তের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। সেখানে কমিটি আছে। স্পেশালিস্টরা (চিকিৎসককে বুঝিয়েছেন) যাচাই-বাছাই করে যাঁরা চেক প্রাপ্য, তাঁদের সুপারিশ করেন।

কালীগঞ্জ ও আদিতমারীর বেশির ভাগ ভুয়া রোগী তাঁর (মন্ত্রী) অথবা তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে চেক পেয়েছেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের এমন দাবির বিষয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর ভাষ্য, ‘আমি এসব বিষয় ডিল করি না।’

রোগী জানে না কী রোগ!

কালীগঞ্জের আমিনগঞ্জে অন্তত ১৭ জনকে ভুয়া রোগী সাজিয়ে ৫০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমিনগঞ্জ বাজারে কথা হয় চেক পাওয়া মোকছেদ আলী ও আবদুল ছালামের সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা কী রোগের জন্য টাকা পেয়েছেন, তা বলতে পারেননি। কিছুক্ষণ থেমে মোকছেদ বলেন, তাঁর হার্নিয়া হয়েছিল।

আবদুস ছালাম বলেন, তাঁর মা সামস্‌ বানু ভোটার আইডি কার্ড হারিয়ে ফেলেছেন। এ জন্য মায়ের বদলে তাঁর নামে চিকিৎসা সহায়তা পেয়েছেন।

কালীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বদিউজ্জামান মন্ত্রীর হয়ে ওই এলাকায় চেক বিতরণের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বড় ভাই ফজলুল করিম, চাচাতো ভাই রবিউল করিম, আনোয়ার হোসেন, মাহবুবার হোসেন, মোবারক হোসেন, ফুফাতো ভাই ছাত্তার আলী, ভাতিজা মনোয়ার করিম চিকিৎসা সহায়তার চেক পেয়েছেন।

রবিউল করিম কী রোগে চেক পেয়েছেন জানতে চাইলে বুকে ব্যথার কথা জানান। ছাত্তার আলী বলেন, তাঁর জটিল কোনো রোগ নেই।

যোগাযোগ করা হলে বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয় তাঁদের চেক দিয়েছেন। এখানে আমি কিছু না।’

আমিনগঞ্জ বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী নুর ইসলাম চেক পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘কী রোগের জন্য চেক দিয়েছে, বদিয়ার (বদিউজ্জামান) মামা বলতে পারবেন।’

পকেট ভারী আ.লীগ নেতাদের

কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রীর আস্থাভাজন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা রোগী না হয়েও বিভিন্ন সময় এই চিকিৎসা সহায়তার চেক পেয়েছেন।

আদিতমারীর মহিশখোচা ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক আউয়াল মিয়া, ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জগদীশ চন্দ্র বর্মণ ৫০ হাজার করে টাকার চেক পেয়েছেন। জগদীশ প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রী তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে এই টাকা উপহার দিয়েছেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের তিনজন চেক পাওয়ার কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেছেন। উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রেফাজ উদ্দিন দাবি করেন, সবাই নয়, যাঁদের মা-বাবা অসুস্থ এমন কয়েকজন নমিনি হয়ে চেক তুলেছেন।

দলীয় নেতা-কর্মীদের চেক দেওয়ার বিষয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দাবি, অভিযোগ সঠিক নয়।  

কালীগঞ্জের ভোটমারী ইউপির সাবেক সদস্য মোহাদ্দেস আলী চিকিৎসা সহায়তার নামে ৫০ হাজার টাকার চেক পান। তাঁর দাবি, সমাজকল্যাণমন্ত্রী তাঁকে ভোট করার জন্য ডেকে এই চেক দেন।

সমাজকল্যাণমন্ত্রীর জ্যাঠাতো ভাই নজরুল ইসলাম তিনবারে দেড় লাখ, মোজাহারুল ইসলাম দুবারে এক লাখ, আরেক ভাই নমিউল ইসলামের স্ত্রী লিলি বেগম ও চাচাতো বোন ফেরদৌসী বেগম ৫০ হাজার করে টাকা পেয়েছেন।

মন্ত্রী তাঁর পরিবারের সদস্যদের চেক পাওয়ার বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছেন। তবে নজরুল ইসলাম তিনবার চেক পাওয়ার বিষয়টি এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন।

ভুয়া রোগী ঘিরে দালাল চক্র

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কালীগঞ্জ ও আদিতমারীতে মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ নেতাদের একটি চক্র তৈরি হয়েছে। তাঁরাই ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ও ভুয়া রোগী বানিয়ে বরাদ্দের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছেন।

উত্তর ঘনেশ্যামের নুরজাহান বেগমের দাবি, তিনি খরচ বাবদ একই এলাকার বাসিন্দা নজরুল মোল্লাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। নজরুল অর্ধশত ভুয়া ফাইল তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পেছনের বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন ভুয়া ফাইল তৈরি করেন। প্রতি ফাইল তৈরিতে ফরহাদ ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা নেন।

৩১ অক্টোবর এ প্রতিবেদক দালালের মাধ্যমে ফরহাদকে ৫০০ টাকা দিয়ে প্রতিবেদকের সফরসঙ্গী সাইফুল ইসলামের ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি ও ছবি দিয়ে ফাইল তৈরি করতে দেন।

পরদিন পাওয়া কাগজপত্রে দেখা যায়, সাইফুলকে জন্মগত হৃদ্‌রোগ বানিয়ে আবেদনপত্রে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জাহিদ বসুনিয়ার সিল, স্বাক্ষর, ওষুধের ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডা. আবু জাহিদ বসুনিয়া প্রথম আলোকে বলেন, এই সিল ও স্বাক্ষর তাঁর নয়।

ফরহাদ হোসেন এ প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন, তিনি বিভিন্ন চিকিৎসকের সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে তিন-চার হাজার ভুয়া ফাইল তৈরি করেছেন।

চেকের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা

আদিতমারীর তালুক পলাশী গ্রামের কাঠমিস্ত্রি মানিক চন্দ্র রায় ও কৃষক জাহাঙ্গীর আলম ২৫ হাজার করে টাকা পেয়েছেন। মানিক ও মজিবর অভিযোগ করেন, উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন আহমেদ তাঁদের নামে চেক তুলে অর্ধেক টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

একই গ্রামের মজিবর রহমানের চুল পড়া রোগ। কিন্তু সুমন আহমেদ তাঁকে ক্যানসার রোগী বানিয়ে ৫০ হাজার টাকা তুলে তাঁকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন। সুমন অবশ্য অভিযোগ স্বীকার করেননি।

কালীগঞ্জের কাঞ্চনশ্বর গ্রামের অন্তত ১৩ জন রোগীর নামে টাকা তুলে ভাগ-বাঁটোয়ারার তথ্য মিলেছে। স্থানীয় বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন, তাঁর পায়ের হাড়ের সমস্যা ছিল। মন্ত্রীর সম্বন্ধীর ছেলে গোলাম মোস্তফা তাঁর নামে ৫০ হাজার টাকার চেক তুলে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। জানতে চাইলে মোস্তফার সাফ জবাব, ‘অনেকে ১০ হাজার করেও পেয়েছেন।’

জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত

ক্যানসার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদ্‌রোগ এবং থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আর্থিক সহায়তা বাস্তবায়ন নীতিমালা ২০১৯ (সংশোধিত) অনুসারে, মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত ২৫ শতাংশের আওতায় জমাকৃত আবেদনগুলোর যাচাই-বাছাই করবে ছয় সদস্যের কমিটি। কমিটির সভাপতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট, কার্যক্রম ও মূল্যায়ন) সুলতানা সাঈদার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠালেও সাড়া মেলেনি।

নিয়ম অনুযায়ী, সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সংশ্লিষ্ট রোগীকে চেক প্রদান করবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও নিয়মের পুরোপুরি ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সালেহ্‌ মোস্তফা কামাল এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, রোগী গুরুতর অসুস্থ বলে রোগীর পরিবার বা নিকটাত্মীয়রা অনেক সময় চেক নিতে চাইলে বিষয়টি মানবিকভাবে দেখা হয়।

ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ক্যানসার, কিডনিসহ জটিল ছয় রোগের রোগীকে সরকারের সহায়তা দেওয়া অত্যন্ত জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ। এটি সংবেদনশীল বিষয়ও। এ রকম ক্ষেত্রেও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা শুধু দুর্নীতি বললে কম বলা হয়। সমাজকল্যাণমন্ত্রীর এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে, তাই তিনি কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এই প্রশ্নটা ওঠা খুবই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। কাজেই মন্ত্রীসহ অন্য যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা অপরিহার্য ও দৃষ্টান্তমূলকভাবে এটা করা উচিত। যাতে এ ধরনের প্রতারণা, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার কেউ করতে না পারে।