২০২০ সালে উৎপাদন স্থগিত হওয়া ৩ চিনিকলে বসানো হয়েছে ইটিপি বা বর্জ্য পরিশোধনাগার। ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি টাকা।
কারখানায় আখ থেকে চিনি তৈরি করতে গিয়ে যে বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তা দূষণমুক্ত করতে ইটিপি বা বর্জ্য পরিশোধনাগারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ইটিপি বসিয়েছে এর বন্ধ তিনটি কারখানায়। এতে ব্যয় হয়েছে অন্তত ২০ কোটি টাকা। বন্ধ চিনিকলে এত টাকা খরচ করে ইটিপি বসানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বন্ধ থাকার পরও ইটিপি বসানো চিনিকল তিনটি হলো দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস লিমিটেড, পঞ্চগড় সুগার মিলস লিমিটেড এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড। জানা গেছে, ইটিপি বসাতে সেতাবগঞ্জে ৮ কোটি, পঞ্চগড়ে প্রায় ৬ কোটি ৮ লাখ এবং রংপুর চিনিকলে প্রায় ৬ কোটি ৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এগুলোতে ইটিপি বসানোর কাজ ২০২২ সালে সম্পন্ন হয়। নির্মাণ শেষ হলেও এই তিন চিনিকলে ইটিপির ব্যবহার হয়নি। উৎপাদন বন্ধ থাকায় আগামী মৌসুমেও এই ইটিপিগুলো ব্যবহৃত হবে না। কবে চিনিকলগুলো চালু হবে, আদৌ চালু হবে কি না, তা করপোরেশন নিজেও জানে না।
আমরা সব কারখানার বিল পেয়েছি। আংশিক তিন কারখানার যেটুকু কাজ করেছি, সেটুকুর বিলও পেয়েছি।প্রকল্পের ঠিকাদার মো. এনামুল হক
এ ছাড়া বাকি বন্ধ তিনটি চিনিকলে ইটিপির যন্ত্রপাতি আনা ও নির্মাণকাজ আংশিক করে বাতিল করা হয়েছে। সেই চিনিকল তিনটি হলো পাবনা সুগার মিলস লিমিটেড, রংপুরের শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড এবং কুষ্টিয়া সুগার মিলস লিমিটেড। এর মধ্যে পাবনা চিনিকলে ইটিপি স্থাপনের জন্য ৪০ ভাগ অবকাঠামো নির্মাণের পর কাজ বাতিল করে দেওয়া হয়। জানা যায়, এই অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়। এর বাইরেও ইটিপির যন্ত্রপাতি এখন পাবনা চিনিকলের গুদামে রয়েছে। তবে ইটিপির যন্ত্রপাতি কিনতে কত খরচ হয়েছে, সেই হিসাব নেই পাবনা চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাছে।
এই প্রকল্পের ঠিকাদার মো. এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব কারখানার বিল পেয়েছি। আংশিক তিন কারখানার যেটুকু কাজ করেছি, সেটুকুর বিলও পেয়েছি।’
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, ১৪টি চিনিকলের জন্যই ইটিপির যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।
জানা যায়, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ৮৫ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৪টি চিনিকলে ইটিপি স্থাপন প্রকল্প শুরু হয়। এর মধ্যে ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সেগুলো এখনো চালু হয়নি। এই ছয়টির মধ্যে তিনটিতে পুরোপুরি ও বাকি তিনটিতে আংশিক ইটিপি বসানো হয়।
বন্ধ কারখানাগুলোতে ইটিপি বসানোর খরচ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. শহীদুল করীম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বলতে পারব না। না দেখে তথ্য দিতে নেই।’
এই কর্মকর্তা জানান, গত জুনে পুরো প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭৯ কোটি টাকা।
কারখানাগুলোয় স্থাপন করা নতুন ইটিপি তিন বছর ধরে চলছে বলেও দাবি করেন এই প্রকল্প পরিচালক। তবে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর এই বক্তব্যের পুরোপুরি সত্যতা পাওয়া যায়নি। গত ১০ জুলাই চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান জানান, সবগুলো ইটিপি এখনো ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেয়নি করপোরেশন। তবে আগামী মৌসুমে চালু চিনিকলগুলোয় স্থাপন করা ইটিপি ব্যবহার করার আশা করছেন তিনি।
গাইবান্ধার রংপুর চিনিকলে গিয়ে দেখা যায়, চিনিকলের প্রধান ফটক বন্ধ। ফটকের এক পাশে ছোট একটি প্রবেশপথ খোলা। প্রশাসনিক ভবনের চারদিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। তবে কারখানার চারদিকে ঝোপজঙ্গল। চিনিকলের যেখানে আখ ফেলা হতো, এর কয়েক গজ দূরেই নির্মিত হয়েছে ইটিপি। এর চারপাশেও ঝোপ-জঙ্গল তৈরি হয়েছে।
বন্ধ চিনিকলে কেন ইটিপি নির্মাণ করলেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে আরিফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইটিপি বসানোর প্রকল্প আগেই শুরু হয়েছিল। তারপর সরকার ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন স্থগিত করে। বেশির ভাগ কাজ শেষ হওয়া কারখানাগুলোয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা হয়েছিল। হঠাৎ করে কাজ বন্ধ করে দিলে যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যেত বিধায় সেগুলোর কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যেগুলোর ইটিপি নির্মাণকাজ কম ছিল, সেগুলোর কাজ বাতিল করেছি।’ আরিফুর রহমান মনে করেন, উৎপাদন শুরু হলে এসব ইটিপি কাজে লাগবে।
উৎপাদন স্থগিত থাকা কারখানার শ্রমিকেরা বলছেন, কবে কারখানা চালু হবে বা শিল্প স্থাপন হবে, তার ঠিক নেই। ফলে ইটিপি স্থাপন অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। রংপুর চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা তবিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক জনপ্রতিনিধি এসে ঘোষণা দেন পুনরায় চিনিকল চালু হবে। চালু হওয়া তো দূরের কথা, উপরন্ত বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করে সরকারের টাকা অপচয় করা হচ্ছে। মাড়াই না হলে পরিশোধনাগার দিয়ে কী হবে? এটিও পড়ে থেকে নষ্ট হবে।
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার সেতাবগঞ্জ সুগার মিলের ইটিপি স্থাপন কাজ শেষ হলেও তা এখনো কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সরেজমিনে দেখা যায়, মূল কারখানার পেছনের অংশে ইটিপি স্থাপন করা হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা বর্গাকৃতির পুকুরের মতো। বর্গাকৃতির পুকুরের মতো এই স্থাপনায় বিভিন্ন যন্ত্রাংশে ঠাসা। তবে ইটিপিতে এখনো সব ধরনের সংযোগ দেওয়া সম্পন্ন হয়নি।
পঞ্চগড় চিনিকলে গিয়ে দেখা যায়, কারখানার চারদিকে সুনসান নীরবতা। মূল ফটকের চেকপোস্টে বসা একজন নিরাপত্তাপ্রহরী। মাঠে পড়ে আছে আখ পরিবহনের পুরোনো নষ্ট হওয়া ট্রাক্টর-ট্রলিসহ নানা যন্ত্রাংশ। বেশির ভাগ জায়গা ভরে গেছে ঝোপ আর লতাপাতায়। মরিচায় ভরে যেতে শুরু করেছে মূল কারখানার মূল্যবান অনেক যন্ত্রপাতি। কিছুটা পূর্ব দিকে এগোতেই দেখা গেল সম্প্রতি নির্মাণ করা ইটিপি। কোনো কার্যক্রম না থাকায় ইতিমধ্যে এর চারদিক ভরে গেছে ঝোপঝাড়ে।
গাইবান্ধার রংপুর চিনিকলে গিয়ে দেখা যায়, চিনিকলের প্রধান ফটক বন্ধ। ফটকের এক পাশে ছোট একটি প্রবেশপথ খোলা। প্রশাসনিক ভবনের চারদিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। তবে কারখানার চারদিকে ঝোপজঙ্গল। চিনিকলের যেখানে আখ ফেলা হতো, এর কয়েক গজ দূরেই নির্মিত হয়েছে ইটিপি। এর চারপাশেও ঝোপ-জঙ্গল তৈরি হয়েছে।
পাবনা চিনিকলে ইটিপি স্থাপনের কাজ আংশিক নির্মাণের পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেখা যায়, মূল কারখানা ভবনের পেছনে আংশিক নির্মিত ইটিপি। দুটি পৃথক স্থানে মাটি খুঁড়ে তোলা হয়েছে রড-সিমেন্টের দেয়াল। রডে মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে। ভেতরটা পুকুরের মতো হয়ে আছে। পানি জমে মশার উৎপাদন হচ্ছে। রংপুরের শ্যামপুর ও কুষ্টিয়া চিনিকলেও প্রায় একই রকম চিত্র দেখা গেছে।
আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় এই ছয় চিনিকলের মাড়াই করার যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই চিনিকলগুলো সরেজমিনে দেখা যায়, কৃষক-শ্রমিকদের সেই হাঁকডাক আর নেই। চারদিকে সুনসান। আখ পরিবহনের ট্রাক্টর, ট্রলিগুলো পড়ে আছে, সেগুলোতে লতাপাতা গজিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় মূল্যবান যন্ত্রাংশ খুলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। মরচে পড়ে নষ্ট হওয়ার উপক্রম অনেক যন্ত্রপাতি। কারখানা ভবনের প্লাস্টার খসে পড়ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ‘যন্ত্রপাতিগুলো যেন নষ্ট না হয়, সে জন্য আমাদের চেষ্টা আছে। তবে কারখানা এভাবে দিনের পর দিন ফেলে রাখলে যন্ত্রপাতি সচল রাখা কঠিন হবে।’
চিনিকল করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘এই চিনিকলগুলো চালু করে চিনির পাশাপাশি অন্য খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের পরিকল্পনা আছে। এ জন্য আগ্রহী বিনিয়োগকারী খুঁজছি। সরকার নিজেও চালু করতে পারে, আবার দেশি–বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাবও পাচ্ছি। তবে এতে সময় লাগবে।’
এই ছয় কারখানার উৎপাদন স্থগিত করা হলেও ব্যয় থেমে নেই। যেমন ১৯৬৪ সালে রংপুরের শ্যামপুর চিনিকলের কারখানা এলাকার আয়তন ৯৯ একর। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে ৪ হাজার ৮০০ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছিল। এই কারখানার উৎপাদন স্থগিত হয়ে গেলেও শ্রমিকদের করপোরেশনের অন্যান্য কারখানায় স্থানান্তর করা হয়েছে। আর এসব সম্পত্তি দেখভাল করার জন্য এখনো এই কারখানায় ৩৩ জন নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছেন, যাঁরা চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। ৮ জন কর্মকর্তা ও ১৫ জন কর্মচারী রয়েছেন এখানে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতির পেছনে মেরামত খরচ রয়েছে। কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা ও স্থাপনা–যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে প্রতিবছর বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হয়। ২০২১–২২ অর্থবছরে এসবের পেছনে ব্যয় করতে গিয়ে প্রায় ৪৪ লাখ টাকা লোকসান দেখিয়েছে কারখানাটি।
এভাবে উৎপাদন স্থগিত থাকা ছয়টি চিনিকলই লোকসান দিচ্ছে। ২০২১–২২ অর্থবছরে এই ছয় চিনিকল ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।
চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের ১৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি চিনিকল, একটি রেনউইক, যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং (বিডি) লিমিটেড এবং কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানই ২০২১–২২ অর্থবছর লোকসান দিয়েছে, যার পরিমাণ ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
বন্ধ চিনিকলে ইটিপি বসিয়ে অর্থ অপচয়ের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ কারণে বন্ধ চিনিকলে ইটিপি বসেছে। এর দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই নিতে হবে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন রাজিউল ইসলাম, দিনাজপুর; রাজিউর রহমান, পঞ্চগড়; শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা; সরোয়ার মোর্শেদ, পাবনা; আরিফুল হক, রংপুর এবং তৌহিদী হাসান, কুষ্টিয়া]।