দেশের ৪টি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে টাওয়ার আছে প্রায় ২৫ হাজার। তবে তারা মাত্র ১৭ শতাংশ টাওয়ার ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে। টেলিযোগাযোগ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, জ্বালানি সংকটসহ বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ভাগাভাগি খুব জরুরি। গত চার বছরে কোনো অপারেটরের মধ্যে কোনো টাওয়ার ভাগাভাগি হয়নি। বিটিআরসি বলছে, টাওয়ার ভাগাভাগিতে অপারেটরদের অনীহা আছে। অন্যদিকে অপারেটররা বলছে, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি নিয়ে কেউই এগোয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেছেন, টাওয়ার ভাগাভাগিতে মোবাইল অপারেটরদের অনীহা আছে। অপারেটরদের সেবার মানের চেয়ে মার্কেটের আকার বৃদ্ধিতে মনোযোগ বেশি। কিছু সমন্বয়হীনতাও আছে। এটা দূর করতে বিটিআরসি কাজ করছে। তিনি বলেন, সাশ্রয় করতে গেলে টাওয়ার ভাগাভাগি অবশ্যই লাগবে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (টিআরএনবি) আয়োজিত ‘নেটওয়ার্ক উন্নয়নে অবকাঠামো ভাগাভাগির চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে মোবাইল অপারেটরদের সেবা ও টাওয়ার ভাগাভাগি নিয়ে এসব আলোচনা হয়।
বেজ ট্রান্সসিভার স্টেশন বা বিটিএস বসিয়ে এলাকা নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়, যা টাওয়ার নামে পরিচিত। এক অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে থাকা টাওয়ার ভাড়ার বিনিময়ে অন্য অপারেটরকে ব্যবহার করতে দেওয়াই টাওয়ার ভাগাভাগি। ভাগাভাগি করলে একই এলাকার মানুষকে নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে চার কোম্পানির অর্থ খরচ করে চারটি টাওয়ার বসানোর প্রয়োজন হয় না। ভাগাভাগির ফলে অর্থ সাশ্রয় হয়। গ্রামাঞ্চলে টাওয়ার বসানোর জন্য জমি নষ্ট হয় না।
বৈঠকে টেলিযোগাযোগ খাত বিশেষজ্ঞ টি আই এম নুরুল কবীর মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মোবাইল অপারেটর টাওয়ার আছে ২৪ হাজার ৪২৫টি। এর মধ্যে শেয়ারকৃত টাওয়ারের সংখ্যা ১৭ শতাংশ। গ্রামীণফোন তাদের টাওয়ারের মধ্যে ১৮ শতাংশ টাওয়ার ভাগাভাগি করে, রবির ৩০ শতাংশ, বাংলালিংকের ১৭ শতাংশ। তবে টেলিটক কোনো টাওয়ার ভাগাভাগি করে না।
মোবাইল ফোন টাওয়ার ভাগাভাগির জন্য ২০১৮ সালে টাওয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিডেট, সামিট পাওয়ার লিমিটেড, কীর্তনখোলা টাওয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড এবং এবি হাইটেক কনসোর্টিয়াম লিমিটেডকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। তাদের হাতে আছে ১৫ হাজার টাওয়ার। এসব টাওয়ারের মাত্র ৩৩ শতাংশ মোবাইল অপারেটররা ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে। বাকি টাওয়ারগুলো মোবাইল অপারেটরগুলোর।
নুরুল কবীর বলেন, টাওয়ার ভাগাভাগি করা হলে জায়গার উপযুক্ত ব্যবহার হবে। দ্রুত নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের মাধ্যমে উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোগত ব্যবস্থার সাশ্রয় হবে। নেপাল, ভারত ও মালয়েশিয়া টাওয়ার ভাগাভাগি পদ্ধতি ব্যবহার করে এগিয়েছে।
টাওয়ার ভাগাভাগির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, টাওয়ার ভাগাভাগি করা হলে সব দিকেই সাশ্রয় হয়। অ্যাকটিভ শেয়ারিং (বেতার তরঙ্গসহ অবকাঠামো ভাগাভাগি) অত্যন্ত জরুরি। মন্ত্রী বলেন, টাওয়ার নির্মাণ টাওয়ার কোম্পানির কাছেই থাকবে। মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির কাছে কখনো যাবে না। বরং যেসব টাওয়ার টেলিকম কোম্পানির কাছে আছে, তা টাওয়ার কোম্পানির কাছে দিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। এ ছাড়া তিনি বলেন, টাওয়ার কোম্পানিগুলোও এমনভাবে টাওয়ার নির্মাণ করবে, যাতে চারটি অপারেটরই সেখান থেকে ভাগাভাগি করতে পারে। যে গাইডলাইন আছে, তা যেন অনুসরণ করা হয়। টাওয়ার ভাগাভাগি নীতিমালা হালনাগাদ করা হচ্ছে।
টাওয়ার ভাগাভাগি করতে দুই অপারেটর ও টাওয়ার কোম্পানির মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির নির্দেশনা দিয়েছে বিটিআরসি। গ্রামীণফোনের নিয়ন্ত্রণে থাকা টাওয়ারগুলো ভাগাভাগির জন্য কোনো পক্ষ থেকে এই চুক্তিই হয়নি বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স হোসেন সাদাত। তিনি বলেন, তিনটি গ্রুপের মধ্যে চুক্তি হতে গেলে প্রত্যেকেই নিজেদের ব্যবসায়িক দিকগুলো দেখে বুঝে এগোবে।
রবি আজিয়াটা লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট অনামিকা ভক্ত টাওয়ার ভাগাভাগির জন্য অন্য অপারেটরের কাছে আশানুরূপ সাড়া পাননি বলে জানান। তিনি বলেন, নেটওয়ার্ক বাড়ানোর জন্য ভাগাভাগি বা টাওয়ার দরকার। এটা না হওয়ায় গ্রাহক ভুক্তভোগী হচ্ছেন।
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, সব অপারেটরের জন্য টাওয়ার ভাগাভাগি বাধ্যতামূলক করা উচিত। বিশ্বে জ্বালানিসংকট চলছে। দেশে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে টাওয়ার ভাগাভাগি খুবই জরুরি।
টাওয়ার ভাগাভাগি হলে দেশীয় কোম্পানি টেলিটকও উপকৃত হবে বলে উল্লেখ করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহাব উদ্দিন আহমেদ।
টাওয়ার কোম্পানি ইডটকো বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রিকি স্টেইন টাওয়ার খাতের কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অনেক টাওয়ার আছে যাতে ভাগাভাগি করার সক্ষমতা নেই। এ ছাড়া এখনো মানুষের মধ্যে টাওয়ার বসানো নিয়ে বিকিরণসংক্রান্ত ভুল ধারণা আছে। সরকার নানা মেগা প্রজেক্ট করছে। এসব করার সময় যেন টাওয়ারের বিষয়গুলোও বিবেচনায় নেওয়া হয়, সে আহ্বান জানান তিনি।
টিআরএনবির সভাপতি রাশেদ মেহেদীর সঞ্চালনায় বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল মতিন, ফাইবার অ্যাট হোমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান মইনুল হক সিদ্দিকী, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক মঞ্জুর হোসেন ও আইএসপিএবি সভাপতি এমদাদুল হক।