সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচার দরকার হতে পারে। কিন্তু অস্ত্রোপচার হচ্ছে ৫০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ৩৫ শতাংশ।
সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দেশে শিশু জন্মে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কমাতে পারছে না। দেশে বর্তমানে অর্ধেকের বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রয়োজন ছাড়াই।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৩ সালের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস ২০২৩) প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশে অস্ত্রোপচারে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এই হার গত বছরের অর্থাৎ ২০২২ সালের চেয়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। গত বছর অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার ছিল ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ।
সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসক সমাজের মধ্যে সমানভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে না উঠলে এই অশুভ প্রবণতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।অধ্যাপক রওশন আরা বেগম, স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ
অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে স্বাভাবিক প্রসবে শিশু জন্ম কমে যাওয়া। ২০২২ সালে স্বাভাবিক প্রসবে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়েছিলে। এক বছর পর ২০২৩ সালে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম হয়েছে ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিশুর। অর্থাৎ ৯ দশমিক ৩ শতাংশ স্বাভাবিক প্রসব কমেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যেকোনো জনগোষ্ঠীতে নানা কারণে কিছুসংখ্যক গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবে মা বা শিশুর বা উভয়ের জীবনের ঝুঁকি থাকে। এই ঝুঁকি এড়াতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচার জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এই জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থার দরকার হয়।
তবে ৫০ শতাংশের বেশি অস্ত্রোপচারকে বিপজ্জনক প্রবণতা বলে বর্ণনা করছেন মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রওশন আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা বিপজ্জনক প্রবণতা। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে অডিট করতে হবে। প্রতিটি হাসপাতালে ও ক্লিনিককে লেবার রুম প্রটোকল (প্রসবঘর নীতিমালা) মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। অধিকাংশ বেসরকারি ক্লিনিকে এটি মানা হয় না।’
রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২৩ সালের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস ২০২৩) প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে, দেশে অস্ত্রোপচারে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এই হার গত বছরের অর্থাৎ ২০২২ সালের চেয়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।
অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু নিয়মনীতি মানা হয়। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার বেশি হচ্ছে, সেখানে সব নিয়মনীতি ঠিকমতো মানা হয় না।
গতকাল বিবিএস যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তাতে কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রোপচার বেশি হচ্ছে তার উল্লেখ নেই। তবে ২০২২ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে বলা হয়েছিল, দেশে ৪৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। ওই জরিপে দেখা যায়, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ৮৩ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে। সরকারি হাসপাতালে ৩৬ শতাংশ এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থার (এনজিও) স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৩৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যেকোনো জনগোষ্ঠীতে নানা কারণে কিছুসংখ্যক গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবে মা বা শিশুর বা উভয়ের জীবনের ঝুঁকি থাকে। এই ঝুঁকি এড়াতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচার জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এই জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থার দরকার হয়।
দেশে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচার দরকার হতে পারে। কিন্তু দেশে অস্ত্রোপচার হচ্ছে ৫০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ জন্মে অস্ত্রোপচারের কোনো প্রয়োজন নেই। এসবই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার।
অস্ত্রোপচারের দুই ধরনের ক্ষতির কথা বলেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। প্রথম ক্ষতি স্বাস্থ্যের। অস্ত্রোপচারে মায়ের শরীরে ক্ষত হয়, অস্ত্রোপচারে বাড়তি ওষুধ খেতে হয়। এ ছাড়া স্বাভাবিক প্রসবের সময় নবজাতক মায়ের শরীর থেকে যেসব উপকারী জীবাণু পায়, অস্ত্রোপচারে তা থেকে নবজাতক বঞ্চিত হয়।
দ্বিতীয় ক্ষতি অর্থের। স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারে খরচ অনেক বেশি। অপ্রয়োজনে বিপুল বাড়তি খরচ করছে দেশের মানুষ।
৫০ শতাংশের বেশি অস্ত্রোপচারকে বিপজ্জনক প্রবণতা বলে বর্ণনা করছেন মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
হঠাৎ করে শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার বাড়েনি। প্রায় দেড় দশক আগে থেকে জনস্বাস্থ্যবিদ ও মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করে আসছিলেন যে দেশে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি বাড়ছে। কিন্তু এই প্রবণতা হ্রাস করতে কার্যকর বা দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ।
২০০০ সাল থেকে দেখা যায় দেশে শিশু জন্ম অস্ত্রোপচার বাড়ছে। ২০০৯ সালের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্ম ছিল ৯ শতাংশ। ২০১১ সালে তা এক লাফে বেড়ে ১৮ শতাংশ হয়। এই প্রথম ১৫ শতাংশের বেশি অস্ত্রোপচার দেখা যায়। এরপর ২০১৪ ও ২০১৭-১৮ জরিপে এই হার হয় যথাক্রমে ২৪ ও ৩৪ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২২ জালের জরিপে তা হয় ৪৫ শতাংশ। আর গতকাল সরকার বলেছে, ৫০ শতাংশের বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে।
এই হার কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন, সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসক সমাজের মধ্যে সমানভাবে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে না উঠলে এই অশুভ প্রবণতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।