গ্যাস-সংকটে পড়ে কারখানা চালাতে নানা উপায় খুঁজছেন দেশের শিল্পমালিকেরা। তিন গুণ বেশি দামে তাঁরা সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে করে গ্যাস নিতে চান শিল্পে। কোনো উপায় না পেয়ে অবৈধ এবং ঝুঁকিপূর্ণ এ উপায়ে কারখানা সচল রাখতে চাচ্ছেন তাঁরা। তবে সরকারের অনুমতি ছাড়া এভাবে গ্যাস দিতে রাজি হচ্ছেন না সিএনজি স্টেশনের মালিকেরা।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে করণীয় জানতে রোববার পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়েছে সিএনজি স্টেশনমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।
সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডার করে গ্যাস নিতে তাদের অনুরোধ করে তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও সিরামিক খাতের সংগঠন বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএমইএ) চিঠি দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে সরকারি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি থেকে প্রতি ইউনিট গ্যাস ১১ টাকা ৯৮ পয়সায় কিনছে বড় শিল্প। আর নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের (ক্যাপটিভ) জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাস কিনছে ১৬ টাকায়। কিন্তু সিএনজি স্টেশন থেকে তাদের কিনতে হবে ৪৩ টাকায়। এর সঙ্গে পরিবহনের খরচও যুক্ত হবে। তবু তারা বাড়তি দামে গ্যাস কিনতে চায়।
সিএনজি স্টেশন ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিভিন্ন দেশে সিলিন্ডারে করে গ্যাস সরবরাহ করার ব্যবস্থা আছে। দেশেও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহ করা হয় সিলিন্ডারে। তাই সরকার সিলিন্ডারে সিএনজি সরবরাহের অনুমোদন দিতে পারে। এতে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত হবে। তাহলে ঝুঁকি এড়িয়ে সিলিন্ডারে সিএনজি সরবরাহ সম্ভব।
তবে পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস বিপণন বিধিমালা অনুসারে, সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে করে শিল্পে গ্যাস সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই। তবে সংকট বিবেচনায় রপ্তানি শিল্পের স্বার্থে সরকার এখন এটি বিবেচনা করতে পারে।
এর আগে বিজিএমই ও বিসিএমইএর পাঠানো চিঠির উত্তর দিয়েছে সিএনজি স্টেশন অ্যাসোসিয়েশন। শনিবার রপ্তানিকারকদের দুটি সংগঠনকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস দিতে হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ সরকারি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লাগবে। এ ছাড়া নিরাপত্তা ও আইনি বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লাগবে।
এ বিষয়ে সিএনজি স্টেশন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস-সংকটে সিলিন্ডারে করে গ্যাস নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। কিন্তু এতে সরকারের অনুমোদন নেই। নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। এখন শিল্পের জন্য জরুরি গ্যাস দরকার। তাই পেট্রোবাংলার কাছে করণীয় জানতে চাওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানায় সিলিন্ডারে করে গ্যাস সরবরাহ করত কোনো কোনো সিএনজি স্টেশন। ১৩ অক্টোবর গাজীপুরের একটি সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস ভর্তির সময় বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। তাৎক্ষণিকভাবে পাঁচজন গুরুতর দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে পরদিন একজন মারা যান। এ দুর্ঘটনার পর থেকেই সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় সিএনজি স্টেশন অ্যাসোসিয়েশন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ অক্টোবর সিএনজি স্টেশন অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি পাঠান বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। এতে বলা হয়, তৈরি পোশাকশিল্পে গ্যাসের চাপ কম থাকায় এবং অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সকাল ৮টার পর গ্যাসের চাপ কমে শূন্যে নেমে আসে, যা রাত ১১টার পর কিছুটা উন্নতি হয়। গ্যাসের অভাবে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরা অলস সময় পার করছেন। নির্ধারিত সময়ে ক্রেতার সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে, একাধিকবার আলোচনা করেও গ্যাস সরবরাহের বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে যেসব শিল্পমালিক সিলিন্ডারে করে গ্যাস নিতে চান, তাঁদের গ্যাস সরবরাহ করার অনুরোধ করেন তিনি।
এরপর ১৯ অক্টোবর গ্যাস সরবরাহের একই অনুরোধ জানিয়ে সিএনজি স্টেশন অ্যাসোসিয়েশনকে চিঠি দেয় বিসিএমইএ সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। এতে বলা হয়, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত, মাঝেমধ্যে টানা কয়েক দিন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকছে। এতে পণ্য ও কারখানার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেও কোনো সমাধান হয়নি।
সিরাজুল ইসলাম মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ না পেলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক মানুষ বেকার হয়ে যাবেন। তাই কোনোরকমে কারখানা সচল রাখতে এ উপায়ে গ্যাস চাওয়া হয়েছে। এটা সাময়িক। গ্যাসের সরবরাহ ঠিক হলেই এটা বন্ধ হয়ে যাবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। একসময় সর্বোচ্চ ৩২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। দুই মাস আগেও দিনে ৩০০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে দিনে ৩৮ কোটি ঘনফুট। যদিও দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের কথা। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি কমানো হয়েছে। সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে গত জুলাইয়ে। এতে গ্যাস-সংকটে ভুগছে শিল্পসহ সব খাত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, শিল্পে গ্যাস সরবরাহ অপরিহার্য। প্রয়োজনে অন্য জায়গায় কমিয়ে হলেও শিল্পে কীভাবে সরবরাহ বাড়ানো যায়, সেটা সরকারের চিন্তা করা উচিত। এ ছাড়া সিএনজি স্টেশন থেকে না হলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কোনো নির্দিষ্ট স্থান থেকে সিলিন্ডারে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার।