এবারের বিশ্ব শিশু দিবসের অনুষ্ঠান উৎসর্গ করা হয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত শিশু-কিশোরদের নামে।
গোলাম নাফিজ (১৭) ও মাহফুজুর রহমান (১৫)। এই দুই কিশোরের মা কেউ কারও পরিচিত নন। তবে সন্তানের মৃত্যু তাঁদের এক করে দিয়েছে। পাশাপাশি বসে দুজন একে অপরের হাত ধরে কাঁদছিলেন। নাফিজ ও মাহফুজুর দুজনই নিহত হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। আজ ৭ অক্টোবর সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এমন সন্তানহারা অনেকের সঙ্গে তাঁরাও আমন্ত্রিত হিসেবে এসেছিলেন।
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমির আয়োজনে এবারের বিশ্ব শিশু দিবসের অনুষ্ঠান উৎসর্গ করা হয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত শিশু-কিশোরদের নামে।
অনুষ্ঠান শেষে ওই দুই মায়ের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। গোলাম নাফিজের নাম বললেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রিকশার রড ধরে পাদানিতে ঝুলতে থাকা ছবিটা চোখের সামনে ভেসে আসে। মা নাজমা আক্তার কান্না চেপে বললেন, ছেলে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। নতুন কেনা ইউনিফর্মটা পরা হয়নি। নাফিজ গত ৪ আগস্ট ফার্মগেটে এবং মাহফুজুর গত ১৯ জুলাই মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হয়। দুজনের লাশই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে থাকা অন্যান্য লাশের মধ্য থেকে খুঁজে বের করেন পরিবারের সদস্যরা। মাহফুজুরের মা বেগম বলেন, ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। এক দিন পর ওর লাশ পাওয়া যায়।
জিগাতলার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া আবুল মোতালিব মুন্না (১৪) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মা–বাবার নাম, বাসার ঠিকানা ও ফোন নম্বর বলে গিয়েছিল। তার লাশ শহীদ মিনারের মিছিল থেকে নিয়ে আসেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান বাবা আবুল মতিন ও মা জাহানারা বেগম। একমাত্র ভাই ইসমাইল হোসেন রাব্বীর (১৭) লাশ কীভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে দুই বোন বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ঘটনা বর্ণনা করে কাঁদছিলেন বড় বোন মিতু আক্তার। ইসমাইল শরীয়তপুরে একটি পলিটেকনিক কলেজে পড়ত।
অনুষ্ঠানে এমন হারানোর বেদনা নিয়ে কথা বলেন পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের কান্নায় মিলনায়তনের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। উপস্থিত সবার চোখ ভিজে যায়। পেশায় ডিজাইনার মো. শাকিল ওয়াহিদ মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, তিন ছেলের নাম রেখেছিলেন প্রিয়, আদর, স্নেহ। বড় ছেলে শাওয়ান্ত মেহতাব প্রিয় আন্দোলনে যেত বললে তিনি একদিন ছেলের পা ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা যাস নে। তুই গুলি খেলে আমি কীভাবে বাঁচব?’ কলেজছাত্র ছেলে আন্দোলন থেকে আর ফেরেনি। তিনি বলেন, শুধু অনুষ্ঠানে সম্মান জানানোর মধ্যে যেন নিহত ছাত্র-জনতাকে স্মরণ করা সীমাবদ্ধ না থাকে। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে পাঠ্যবই ও ইতিহাসে এমনভাবে স্থান দিতে হবে, যেন তাঁদের নাম কেউ মুছে না দিতে পারে।
নাটোর জেলার জামায়াতের নায়েবে আমির মো. দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, তিনি নাটোর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ। আন্দোলনে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ২৮ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি জেলে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন, ৫ আগস্ট তাঁর কিশোর ছেলে মিকদাদ হোসেন খানকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
মঞ্চে সন্তানদের কথা বলতে গিয়ে হত্যাকারীদের বিচার চাইলেন জুবায়ের আহমেদের বাবা মো. কামাল উদ্দিন এবং ফারহান ফাইয়াজের বাবা শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া ও ছোট বোন সায়মা ইসলাম। জুবায়েরের বাবা কামাল উদ্দিন বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কোনো প্রক্রিয়া এখনো দেখা যাচ্ছে না। ফারহানের বাবা শহীদুল ইসলাম ভুঁইয়া নিহত ব্যক্তিদের শহীদের মর্যাদা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করার অনুরোধ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘এই শিশু-কিশোরদের আত্মত্যাগ থেকে আমি এই শিক্ষা নিই যে, যে দেশ আমরা গড়ে তুলেছি, সে দেশে শিশুরা কোনো ভবিষ্যত খুঁজে পায় না। আমরা দায়িত্বশীল ছিলাম না।’ তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়েছিল। শিশু-কিশোরদের হাত দিয়ে গণতন্ত্রের সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে ওঠার প্রত্যাশা করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক ও বিশেষ অতিথি হিসেবে ইউনিসেফের ডেপুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ এমা ব্রিগহাম বক্তব্য দেন। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক তানিয়া খান। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করে দুই কিশোর-কিশোরী নাজিয়া আলম ও ফাহিম রহমান। অনুষ্ঠান শেষে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, ১০৫ জন নিহত শিশু-কিশোরদের তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্য থেকে ৯০ জনের প্রত্যেকের পরিবারের সদস্যদের হাতে স্মারক সম্মাননা ও ৫০ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড তুলে দেওয়া হয়। তবে এই তালিকায় বেশ কিছু শিশু-কিশোরদের নাম বাদ পড়েছে বলে জানা গেছে।
উত্তরায় ৪ আগস্ট গুলিতে নিহত আব্দুল্লাহ আল মাহিন (১৬) নামের এক কিশোরের বাবা জামিল হোসেন অনুষ্ঠানে এলেও জানতে পারেন তাঁর ছেলের নাম তালিকায় ওঠেনি। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, দুই দিন আগে তাঁকে ফোন করে অনুষ্ঠানে আসতে বলা হলেও পরে অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে বলে জানানো হয়। অন্য এক মারফতে অনুষ্ঠান হবে জানতে পেরে তিনি এসেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক তানিয়া খান বিষয়টি দেখার দায়িত্ব দেন জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুল হককে। নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকার কথা ছিল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তাঁর নির্ধারিত সময়সূচির সঙ্গে না মেলায় তিনি অনুষ্ঠানে থাকতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সেই সময় অনুষ্ঠান একবার বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পরে তা আবার বহাল রাখা হয়। মাহিনসহ যেসব নিহত শিশু-কিশোরের নাম বাদ পড়েছে, তাদের পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ করলে নাম তালিকায় লিপিবদ্ধ করে শিশু একাডেমি থেকে সম্মাননা দেওয়া হবে।