পাঁচ বছর আগে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যাওয়ার পথে সপরিবার দুর্ঘটনার শিকার হন জেসমিন আক্তার (২৭)। স্বামী আবদুস শুক্কুর, ছয় বছর বয়সী মেয়ে তাসফিয়াসহ মোট পাঁচজন ছিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশায়। টেকনাফের প্রধান সড়কে ওঠার পরই আরেকটি অটোরিকশার সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান জেসমিনের স্বামী। গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন জেসমিন। সেখানে তাঁর ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফকিরাপুলের একটি আবাসিক হোটেলে বসে জেসমিনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সঙ্গে ছিল তাঁর মেয়ে তাসফিয়া। টেকনাফের গ্রামের বাড়িতে জেসমিন সেলাইয়ের কাজ করে মা-মেয়ের সংসার চালান। তিনি ঢাকায় এসেছেন একটা ভিন্নধর্মী আয়োজনের অংশ হতে।
অঙ্গহানি হয়েছে কিংবা জন্মগতভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ত্রুটি আছে—এমন ব্যক্তিদের জন্য বেসরকারি স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স (শি) এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) যৌথ আয়োজনে পাঁচ দিনব্যাপী অ্যাম্পুটি (অঙ্গচ্ছেদ) ফুটবল প্রশিক্ষণে জেসমিন অংশ নিচ্ছেন।
জেসমিন হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘স্থানীয় বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে যখন এই প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব পাই, তখন অবাক হয়ে যাই। এক পায়ে আবার ফুটবল খেলে কীভাবে!’
হোটেলে থাকা অন্য মেয়েরাও জেসমিনের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। জেসমিনের মতো মোট ১৩ জন মেয়ে এই আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন। তাঁরা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। কারও জন্মগতভাবে হাত-পা ছোট বা অসম্পূর্ণ।, কেউ দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছেন, কারও অঙ্গহানি হয়েছে ক্যানসার-টাইফয়েডের মতো অসুস্থতা থেকে। তবে এসব তাঁদের থামিয়ে দিতে পারেনি। কেউ পড়াশোনা করছেন, কেউ পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করছেন, কেউ–বা উদ্যোক্তা।
আয়োজনের সহযোগিতায় রয়েছে বাংলাদেশ অ্যাম্পুটি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (বাফা), ওয়ার্ল্ড অ্যাম্পুটি ফুটবল ফেডারেশন ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। ঢাকায় বাফুফের কৃত্রিম টার্ফে ফুটবল ক্যাম্প ও কোচদের প্রশিক্ষণ শুরু হয় ৬ অক্টোবর। আজ বৃহস্পতিবার এই আয়োজনের শেষ দিন। আজ একই মাঠে বেলা একটায় প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ হয়। ঢাকার এই আয়োজনে প্রশিক্ষক হিসেবে রয়েছেন ওয়ার্ল্ড অ্যাম্পুটি ফুটবল ফেডারেশনের ব্রিটিশ কোচ ও শিক্ষাবিদ হ্যারি স্মিথ।
শি-এর উন্নয়নের জন্য ক্রীড়া বিভাগের প্রধান পাপ্পু মোদক প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় এই প্রথম নারী অ্যাম্পুটি ফুটবল শুরু হলো। এই আয়োজনে ১৩ জন নারী ফুটবলার ছাড়াও ১৪ জন পুরুষ ফুটবলার এবং ১৫ জন কোচ (নারী-পুরুষ মিলিয়ে) অংশ নিচ্ছেন।
ঢাকার এই আয়োজন মূলত শি ও আইসিআরসির অনুগামী (ফলোআপ) কাজ। এর আগে সংগঠন দুটি শ্রীমঙ্গলে গত ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই নারীদের ফুটবল প্রশিক্ষণ ও ম্যাচের আয়োজন করেছিল।
খেলার সময় সব বেদনা ভুলে যান
তানজিলা আক্তার শিলা (২১) রাজধানীর গুলশান কমার্স কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়ছেন। পাঁচ ভাই–বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। থাকেন রাজধানীর রামপুরায়, মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে।
২০১৪ সালের নভেম্বরে শিক্ষকের বাসায় পড়তে গিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনার শিকার হন তানজিলা। তখন তানজিলার বয়স ছিল ১১ বছর। দুর্ঘটনায় দগ্ধদের মধ্যে মারা যায় তাঁর ভাগনি আশরাফী (৭)। আর তানজিলার মুখমণ্ডলসহ শরীর দগ্ধ হয়। পরে ডান পায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তা কেটে বাদ দেন চিকিৎসকেরা। সেই দুঃসহ স্মৃতি তানজিলাকে তাড়া করে বেড়ায়। তবে এই ফুটবল খেলা তাঁর চিন্তাভাবনাকে পাল্টে দিয়েছে।
তানজিলা বললেন, ‘আমি ভাবতাম, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি এক পায়ে ফুটবল খেলা যায়। আর এখন ফুটবল খেলার মধ্যে নিজেকে যুক্ত রাখার স্বপ্ন দেখছি। খেলার সময় সব বেদনা, দুশ্চিন্তা ভুলে যাই। শরীরেও সুস্থতা বোধ করি।’
এই মেয়েদের কারও গল্প কারও চেয়ে কম বেদনার নয়। পিরোজপুর থেকে আসা সুমাইয়া আক্তার (১৭) একটি কৃত্রিম পা ব্যবহার করে। একসময় তার বাবা ঢাকার একটি হোটেলে চাকরি করতেন। তিন বছর বয়সে বাবার সঙ্গে দেখা করে সুমাইয়াকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন তার মা। বিমানবন্দরের সামনের সড়কে একটি বাসে চালকের সহকারীর কোলে সুমাইকে দিয়ে মা নিজে ব্যাগ নিয়ে উঠতে যান। কিন্তু বাসটি তখন ছেড়ে দিলে তিনি আর উঠতে পারেননি। সুমাইয়াকে নেওয়ার জন্য মা বাসের পেছন পেছন দৌড়াতে থাকেন। চালক বাসের গতি কমান। তখন সুমাইয়াকে বাস থেকে নামিয়ে দেন চালকের সহকারী। ছোট্ট সুমাইয়া ঝোঁক সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। বাসের চাকা তার পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। অনেক দিন চিকিৎসার পর তার ডান পা কেটে বাদ দিতে হয়।
খেলাধুলা প্রচণ্ড আনন্দ দেয় জানিয়ে সুমাইয়া বলে, তার বাবা ও বড় দুই ভাই ফুটবল খেলেন। ছোটবেলায় মাঠের পাশে (সাইডলাইন) বসে হাত দিয়ে কত দিন বল পাস করেছে সে। কিন্তু কোনো দিন ভাবেনি, নিজেও খেলবে। অ্যাম্পুটি ফুটবল খেলার ক্রাচগুলো একটু খোলা ধরনের। সেটায় ভর করে প্রথম খেলতে গিয়ে হাত ছিলে যেত। এখন এতটাই দক্ষ হয়েছে, ওই ক্রাচে ভর করে ফুটবল নিয়ে দ্রুত দৌড়ে যেতে পারে।
কোচ কাকলী আক্তার বলেন, ‘মেয়েদের খেলার আগ্রহ দেখে আমার নিজেরও সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।’
আত্মবিশ্বাস বেড়েছে
ছোটবেলায় টাইফয়েডে বাঁ পা অসাড় হয়ে যায় সিলেটের ফাহিমা আক্তারের। তিনি এখন এমএ ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘খেলতে আসার পর আমার মনে সাহস এসেছে যে এ ধরনের শারীরিক পরিস্থিতির মধ্যেও খেলা যায়।’
টেকনাফ থেকে আসা ইয়াসমিন আক্তার (২৩) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে সম্মান তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। পাশাপাশি একটি এনজিওতে চাকরি করেন। ১১ বছর বয়সে একতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে ডান পা হারান। তিনি বলেন, খেলায় যুক্ত হওয়ার পর তাঁর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এই অনুভূতি তাঁকে সামনে চলার পথে শক্তি জোগাচ্ছে।
রংপুরের কারমাইকেল কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করছেন মুক্তা আক্তার (২৪)। জন্মগতভাবে তাঁর ডান হাত নেই। বাঁ হাত দিয়ে পড়ালেখা করে এ পর্যন্ত এসেছেন। তাঁর কাছেও খেলা মানে শরীর-মন সতেজ থাকা, আত্মবিশ্বাস বাড়া।
গাজীপুরের শ্রীপুরের ফাতেমা আক্তারের বাঁঁ পা কৃত্রিম এবং বাঁ হাতের কবজি নেই। কলেজছাত্রী ফাতেমার এই ত্রুটি জন্মগত। ফাতেমা বলে, খেলার প্রস্তাব পাওয়ার পর সে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিল। তবে মা তাকে বলেন, ‘তুমি খেলতে যাও। তুমি পারবে।’
জন্মগতভাবে ডান হাত ছোট সিলেটের মোসাম্মৎ নাসরিন আক্তারের (১৭)। সে আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। নাসরিন বলে, তাকেও মা পাঠিয়েছেন। চাচারা বলছিলেন, ‘ও খেলায় গিয়ে পারবে না।’ মা বলেন, ‘গিয়ে দেখুক, পারে কি না।’
৬ মাস বয়সে প্রচণ্ড জ্বর থেকে বাঁ পা অসাড় হয়ে যায় মোয়াজ্জেমা খাতুনের (২৬)। দলের ক্যাপ্টেন রজনী খাতুন (১৬) পাবনার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ছোটবেলায় দৌড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাকের নিচে পড়ে বাঁ পা হারায় সে। কক্সবাজারের রামু উপজেলার অভীপ্সা বড়ুয়া মণি (১৫) ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পা হারায়। কক্সবাজারের শাহেদা বেগম (১২) ও উখিয়ার আফনান জাহানের (১১) জন্মগতভাবে পা অসম্পূর্ণ। তাঁরা সবাই জানান, খেলার মাধ্যমে তাঁদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে।
স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্সের (শি) প্রতিষ্ঠাতা শারমিন ফারহানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে অনেক মেয়ে ইচ্ছা থাকলেও খেলাধুলার সুযোগ পান না। আর বিভিন্ন কারণে যাঁদের অঙ্গহানি হয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে সুযোগ আরও কমে যায়। এই মেয়েরা বেদনাদায়ক স্মৃতি থেকে বের হয়ে আত্মবিশ্বাস যাতে অর্জন করতে পারেন, সে লক্ষ্যেই এ আয়োজন। খেলতে খেলতেই তাঁদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে। এখান থেকে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, তা তাঁদের পরবর্তী সময়ে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় সহায়ক হবে।