আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট: লক্ষ্য থেকে বেশ দূরে প্রতিষ্ঠানটি

দুই যুগ বয়সী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের একটি বড় অর্জন, ভাষা নিয়ে দেশজুড়ে ‘ক্ষেত্রসমীক্ষা’র কাজটি শেষ করা এবং পাঁচ খণ্ডে বহুভাষী পকেট অভিধান প্রণয়ন করা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন দিবস পালন এবং সেমিনারের আয়োজন করে আসছে। কিন্তু যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছিল, সে অর্জন থেকে প্রতিষ্ঠানটি এখনো অনেক দূরে। ক্ষেত্রসমীক্ষায় উঠে আসা দেশের বিপন্ন ভাষা সংরক্ষণ উদ্যোগের গতিও ধীর।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হাকিম আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাষা নিয়ে গবেষণা সব সময়ই সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে যে কর্মপরিকল্পনা দরকার, সেটি সত্যিকার অর্থে করা হয়নি।’

তবে ভাষাবিদেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গবেষকদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো জরুরি। নইলে প্রতিষ্ঠানটি লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়েই থাকবে।

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসার। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং গবেষণা করাও উদ্দেশ্য। এই ভাবনা নিয়ে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হলেও মূল কার্যক্রম শুরু হয় ২০১০ সালে। মাঝখানে রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল পাঁচ বছর।

১৯৯৯ সালে ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের ঘোষণা দেন।

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন-২০১০ অনুযায়ী, এই ইনস্টিটিউটের ২৩টি দায়িত্ব পালন করার কথা। এর মধ্যে প্রথম দায়িত্ব ‘দেশে ও দেশের বাহিরে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ।’ প্রতিষ্ঠানের আইন অনুসারে দ্বিতীয় দায়িত্ব ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, এতৎসংক্রান্ত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা’। তবে নানা রকম সংকটে প্রতিষ্ঠানটির অর্জনের গতি ধীর।

লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে

বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ শেষ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ দেশে কতগুলো ভাষায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠী কথা বলে, কোন ভাষাভাষীর সংখ্যা কত, কোন ভাষার নিজস্ব লিপি আছে—এ নিয়ে সারা দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে এ সমীক্ষার কাজ শুরু হয়। ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলাফল নিয়ে ১০ খণ্ডে বই হওয়ার কথা। সেগুলো প্রকাশিত হলে দেশের ভাষা নিয়ে একটি পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে। কিন্তু ২০১৬ সালে কাজ শেষ হলেও গত সাত বছরে প্রকাশিত হয়েছে বইয়ের একটি মাত্র খণ্ড।

সমীক্ষায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ৪১টি ভাষা আছে। এর মধ্যে ১৬টির নিজস্ব লিপি রয়েছে। বাকি ২৫টি ভাষা লিপিহীন। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আরেক দায়িত্ব লিপিহীন ভাষাগুলোর জন্য লিপি প্রবর্তন করা। সেসব কাজ এগোয়নি প্রতিষ্ঠানের।

বাংলাদেশের ৪১টির মধ্যে ১৪টি ভাষা চিহ্নিত হয়েছে বিপন্ন হিসেবে। অর্থাৎ এই ১৪টি ভাষায় কথা বলা জনসংখ্যা পাঁচ হাজারের কম। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব বিপন্ন ভাষাগুলো সংরক্ষণের জন্য প্রথমে সেগুলোর অভিধান এবং এরপর ব্যাকরণ তৈরি করা।

এ পর্যন্ত ৪১টির মধ্যে ৩টি ভাষার অভিধান তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে একটি-বেদে জনগোষ্ঠীর ‘ঠার’ ভাষার অভিধান। পুরান ঢাকার ঢাকাইয়া উর্দু আর কোচ ভাষার অভিধান মুদ্রণের কাজ চলছে। ফলে এ কাজের অগ্রগতিও মন্থর। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘কাজ শেষ করতে তথ্যগত সংকট আছে। ভাষাবিশেষজ্ঞরা অনেক সংশোধনী দিয়েছেন। সে সংশোধন করতে সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে।’

প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম প্রধান কাজ ছিল দেশে-বিদেশে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ, পাশাপাশি বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকীকরণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া। এ বিষয়ে কিছু সেমিনার ও স্মরণিকা প্রকাশ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কাজ দেখা যায় না।

বর্তমানে যে কাজ চলছে

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বর্তমানে ‘মাতৃভাষা পিডিয়া’ নিয়ে কাজ করছে। এই পিডিয়ায় পাওয়া যাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষার ইতিহাস, উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে তথ্য। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে এর ১০টি খণ্ড প্রকাশের কথা। তবে একজন কর্মকর্তা সংশয় প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এখন কেবল প্রথম খণ্ডের কাজ চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ১০ খণ্ড প্রকাশের সম্ভাবনা কম।

প্রতিষ্ঠানটি ভাষাবিষয়ক গবেষণার জন্য বৃত্তি চালু করেছে। এর আওতায় ১৩ জন গবেষক ভাষা নথিভুক্তকরণ, ভাষার হারিয়ে যাওয়া উপাদান সংরক্ষণ এবং অভিধান তৈরি নিয়ে কাজ করছেন। পোস্ট ডক, পিএইচডি, এমফিল, ফেলোশিপ ও প্রফেশনাল—এই পাঁচ ভাগে কাজ চলছে। এর মধ্যে তিন বছরের পিএইচডি করছেন তিনজন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি দেশের ছয়টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ভাষান্তর করেছে। এ ছাড়া বহুভাষী পকেট অভিধান তৈরির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিটি অভিধানে বাংলা ও ইংরেজি শব্দের সঙ্গে রয়েছে আরও তিনটি করে ভাষায় নির্দিষ্ট শব্দটির অনুবাদ, ব্যবহার। যেমন একটি খণ্ডে বাংলা, ইংরেজির সঙ্গে ওই নির্দিষ্ট শব্দের জার্মান, রুশ ও স্প্যানিশ শব্দ আছে। আরেক খণ্ডে বাংলা, ইংরেজির সঙ্গে আরবি, ফারসি এবং তুর্কি ভাষায় সে শব্দটি রয়েছে। এভাবে মোট ১৬টি ভাষার ৫ খণ্ডের পকেট অভিধান তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। দেশের বাইরে যে কেউ এই অভিধান সহজে ব্যবহার করে জরুরি কাজ শেষ করতে পারবেন বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

ভাষা প্রসঙ্গে দেশ ও বিদেশের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনেক সেমিনার ও সভা হয়েছে। প্রকাশিত হচ্ছে জার্নাল। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি এ বছর আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ভাষা অলিম্পিয়াডের।

তবে এসব আয়োজন, দিবস পালন, বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হলেও মূল কাজ থেকে অনেক পিছিয়ে থাকার কথা স্বীকার করলেন বর্তমান মহাপরিচালকও। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষ জনবল নেই। বাজেট থাকে না। তাঁরা বলছেন, অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ আটকে থাকে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়।

সংকট নিয়ে যা বলছে কর্তৃপক্ষ

বিশ্বে ৭ হাজার ১০২টি জীবিত ভাষা আছে। এটি ২০১৫ সালে প্রকাশিত এথনোলগ: ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর প্রতিবেদনের তথ্য। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তাদের ভাষাসমীক্ষা নিয়ে প্রকাশিত প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে পাওয়া ৪১টি ভাষার মধ্যে খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, খুমি, পাংখোয়াসহ ১৪টি ভাষা বিপন্নের তালিকায়। এসব ভাষার লিপিকরণের দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানের। সে কাজটি যেমন হচ্ছে না, তেমনি এখনো বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া নিয়েও আছে উদ্যোগের অভাব।

মূল কাজ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হাকিম আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে মাতৃভাষা বিকশিত হয়নি এবং যে ভাষাগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে, সেগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভাষা নিয়ে গবেষণাকাজ সব সময়ই সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে যে কর্মপরিকল্পনা দরকার, সেটি সত্যিকার অর্থে করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের অনির্ধারিত কাঠামো আর দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে।’

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের বর্তমান সংকট নিরসনে করণীয় জানতে চাইলে ভাষাবিদ শিশির ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের সব জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে এখানেই গবেষণা হওয়া উচিত। ব্যাকরণ, শব্দকোষের বর্ণনা হওয়া দরকার। কিন্তু শিক্ষা-গবেষণায় আমরা জাতিগতভাবেই দুর্বল। প্রাথমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় জোর না দিলে উচ্চ স্তরের সংকটের সমাধান করা যাবে না। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য গবেষক ও আমলাদের মধ্যে কাজের সমন্বয় হওয়া দরকার। গবেষকদের নিয়োগ দিতে হবে বেশি। তাহলে ধীরে ধীরে সমাধান হবে। তবে প্রতিষ্ঠানটির স্বায়ত্তশাসন দরকার।’