উম্মে হাবিবা নূহা স্কুলে থাকতেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিতে যুক্ত হন। বন্ধুরা মিলে বই পড়েন, আবার এসব বইয়ের ওপর পরীক্ষাও দিতেন দল বেঁধে। নূহা এখন কলেজে পড়েন। আগের মতো কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ না নিতে পারলেও বই পড়ার অভ্যাস রয়ে গেছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৪৫ বছর পূর্তির উৎসবে আমন্ত্রণ পেয়ে মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে চলে এসেছেন তিনি।
আলোকিত মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ৪৫ বছর পার করেছে। এ উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে তাদের উৎসব। সব বয়সী মানুষের অংশগ্রহণে সেই উৎসব পরিণত হয়ে মিলনমেলায়।
নূহার মতো কলেজশিক্ষার্থী যেমন এসেছেন, তেমনি ৫০ ছুঁই ছুঁই রুবাইয়াত ইসলামও স্মৃতির টানে যোগ দিয়েছেন এই উৎসবে। তিনি বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে পরিচিত হন। অনেক বই নিয়ে পড়েছেন, আড্ডা দিয়েছেন। উৎসবের কথা জানতে পেরে তিনিও এসেছেন।
৪৫ বছর পূর্তির উৎসবটা শুরু হয় শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে। দোয়েল, শাপলা, মাথায় রংবেরঙের টোপর, পরনে বাহারি সাজ, ঢাকের তালে তালে ও নৃত্যের মধ্য দিয়ে শাহবাগের জাদুঘরের সামনে শুরু হওয়া শোভাযাত্রা বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে প্রবেশ করে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় এই শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রার সময় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ৪৫ বছরে বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। স্রোতের বিপরীতে গিয়েও যে কিছু একটা করা যায়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রাস্তায় রাস্তায় বইয়ের লাইব্রেরি ছুটে বেড়ানোর বিষয়টি একসময় অকল্পনীয় ছিল। তাঁর ধারণা, আরও ৪০ বছর পর পুরো বাংলাদেশেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলো ছড়িয়ে পড়বে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এ উৎসবে অংশ নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের স্বপ্ন দেখা এবং ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা আছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে জাগ্রত করছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আজ বাস্তবায়িত—বলেন সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।
নাট্যব্যক্তিত্ব খায়রুল আলম সবুজ বলেন, একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও সাহস দিয়ে স্যার (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) দেখিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকেও বড় কিছু করা যায়।
শোভাযাত্রা শেষে পুরো আয়োজন ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনের মিলনায়তনসহ বিভিন্ন তলায়। উৎসবজুড়ে ছিল দেশীয় লোকশিল্প ও ঐতিহ্যের সমাহার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সামনের সড়কজুড়ে ছিল আলপনা। আপ্যায়নে ছিল মোয়া, গজা, নাড়ু, পিঠা। দেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা দিনভর গান শোনান। ছিল মণিপুরি, কত্থক নৃত্য এবং আবৃত্তি। বিশিষ্ট জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ জাদু দেখিয়ে দর্শকদের মোহিত করেন।
গান পরিবেশন করেন ফরিদা পারভীন, ফাতেমা তুজ জোহরা, ফাহমিদা নবী, ফেরদৌস আরা, অনিমা রায়, নবনীতা চৌধুরী, কোনাল, প্রিয়াঙ্কা গোপসহ অনেকেই। ছিল চিরকুট ব্যান্ডের পরিবেশনা।
সারা দিনই বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের আনাগোনায় মুখর ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রাঙ্গণ। গুণীজনেরাও এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে যান।
শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আবদুস সামাদ, সাবেক সচিব খোন্দকার মো. আসাদুজ্জামান ও আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, অধ্যাপক পারভীন মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার, বিকাশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কামাল কাদীরসহ অনেকে।
শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ, কালের কণ্ঠ–এর প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অভিনেত্রী আফসানা মিমি, উপস্থাপক আলমগীর হোসেন ও দীপ্তি চৌধুরী।