প্রাণী

নিরীহ প্রাণী খরগোশ

চুয়াডাঙ্গার বেলগাছি থেকে খরগোশের ছানার ছবি তুলেছেন বখতিয়ার হামিদ
চুয়াডাঙ্গার বেলগাছি থেকে খরগোশের ছানার ছবি তুলেছেন বখতিয়ার হামিদ

ঢাকার মুগদাপাড়ার স্টেডিয়ামের বাইরে প্রতি শনিবার বসে ‘কবুতরের হাট’। সেখানে নানান প্রজাতির কবুতর কেনাবেচা হয় ভালোই। মাঝেমধ্যে হেঁটে ওই হাটে আমি যাই।

গত ১৬ জুলাই বেলা ১১টার দিকে গিয়ে খাঁচাবন্দী খরগোশের দুটি পিচ্চি ছানা দেখে চমকে উঠলাম। হাটের সীমানার বাইরে একটু নিরিবিলি স্থানে ভিড় করা মানুষের অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইছেন না, এই দুটি হলো ফইট্টা খরগোশের ছানা। পাশ থেকে একজন বললেন, বড় জাতের কোনো ইঁদুর হবে! আমার চোখে অবিশ্বাস আর বুকের ভেতরে ঝড়—মায়ের দুধ পান করা এই দুটি পিচ্চি ছানা এল কোত্থেকে!

মাথার ভেতরে বইছে চিন্তার ঝড়। খাঁচার পাশে বসলাম। বিক্রেতা গর্বের সঙ্গে বললেন, এ হলো পাহাড়ি ফইট্টা খরগোশ। গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে নিয়ে এসেছেন। ঢাকায় বেশি দাম পাওয়া যাবে। তাই বাসে চলে এসেছেন। এক দাম দুই হাজার টাকা। পোষা যাবে সহজে। ফিডারে ছাগলের দুধ বা বেশি করে পানি মিশিয়ে গরুর দুধ খাওয়ালে তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠবে।

আমি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম। এই ছানা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তা আমার খুব ভালো জানা আছে। এক দাম দেড় হাজার টাকা বলে দুই শ টাকা অগ্রিম দিয়ে, দ্রুত বাসায় এলাম। টাকা নিয়ে আবারও হাটে যেতে বড়জোর ১৫ মিনিট লাগল। গিয়ে দেখি বিক্রেতা নেই! পাশের লোকজন বললেন, দেড় হাজার টাকায় কিনে নিয়ে গেছেন এক ভদ্রমহিলা। কী যে কষ্ট পেলাম! ইচ্ছা ছিল কিনে নিয়ে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করব।

নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম প্রবলভাবে। কেননা, আমার শৈশব-কৈশোরে গ্রামের কিছু মানুষ জাল পেতে এই খরগোশ ধরতেন, মাংস খেতেন। চাঁদনিরাতে আমার বাবাকেও দেখেছি কলাই, মসুর ও মুগডালের খেত থেকে বন্দুকের গুলিতে শিকার করতে। গ্রামের অনেক শিশু-কিশোর ছানা পুষত। পুষেছি আমিও। তখন (ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত) বৃহত্তর খুলনা জেলায় খরগোশ সুলভ ছিল, ছিল সারা বাংলাদেশেই। এখন আর নেই। নিরীহ, সুন্দর, লাজুক ও ডাগর চোখের ভীত স্বভাবের এই প্রাণী দারুণ ‘লম্ফবিদ’।

অকারণে টেনশনে ভোগে। আমার গ্রামের মাঠগুলোতে, খড়বন, কাশবন, ঝোপঝাড় ও পানের বরজ এবং উঁচু ভিটাজমিতে যথেষ্টই ছিল। আখখেত ছিল এ প্রাণীর প্রিয় আশ্রয়স্থল। এখন সিলেটের চা–বাগান এলাকা, কুষ্টিয়ার কিছু এলাকা; চুয়াডাঙ্গা ও যশোরের কিছু স্থানসহ অন্য এলাকায় এই খরগোশ কোনোরকমে টিকে আছে। দেশে প্রাণীটি এখন বিরল ও বিপন্ন বলে বিবেচিত।

প্রাণীটি খরগোশ, আমাদের আবাসিক প্রাণী। মূল খাদ্য ঘাস, পাতা, শিকড়-কন্দ, ফল, বীজ ও শস্যদানা। মসুর ও মুগডাল অতি পছন্দ। এ প্রাণী ঘাসবন, খড়বন, কাশবন, আখখেতসহ অন্যান্য জায়গায় চমৎকার তাঁবু-বাসা বানিয়ে এক থেকে চারটি ছানা প্রসব করে। গর্ভধারণকাল ৪১ থেকে ৪৭ দিন। সদ্যোজাত ছানা দেখতে দারুণ সুন্দর। কেননা, এর শরীরে লোম থাকে, চোখও থাকে খোলা। খরগোশ একাধিক বাসা বানায়।

নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে ছানার ঘাড় কামড়ে ধরে এক বাসা থেকে অন্য বাসায় স্থানান্তর করে। এই খরগোশ বাগেরহাটে ‘লাফা’ নামে ব্যাপক পরিচিত ছিল। গাজীপুরে পরিচিত ছিল ‘ফইট্টা’ নামে। এ ছাড়া লাফারু-শশক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়ান হেয়ার’। বৈজ্ঞানিক নাম Lepus nigricollis. শরীরের দৈর্ঘ্য ৪৫ সেমি। লেজ ১০ সেমি। ওজন ১.৩৫ থেকে ০৭.০ কেজি।