৩ জনের মরদেহ বের করে মহাপরিচালক পদক পায় ‘চিতা’

র‍্যাবের ব্যাচ ও পদক বসানো বেল্ট গলায় ‘চিতা’
ছবি : এস এস আল আরেফিন

৭ মার্চ রাজধানীর গুলিস্তানের বিআরটিসির বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে পাশের সাততলা ও পাঁচতলা দুটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুইন মার্কেটের সাততলা ভবনটির বেজমেন্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় তলা বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় ২৫ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন সড়কে থাকা এবং ভবনগুলোতে থাকা শতাধিক মানুষ।

প্রথম দিনেই সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা হয় অধিকাংশ মরদেহ। দ্বিতীয় দিনের শুরু থেকেই নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হতে থাকে পরিবেশ। কিন্তু ততক্ষণে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ভবনটিতে বিস্ফোরণের কারণ ও কেউ আটকা পড়ে আছেন কি না, তা অনুসন্ধান করতে ডাকা হয় র‍্যাবের ডগ স্কোয়াড।

‘চিতার’ গলায় পদক পরিয়ে দিচ্ছেন র‍্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন

দুটি বিস্ফোরক শনাক্তকারী কুকুরের সঙ্গে ২টি উদ্ধারকারী কুকুরও আনা হয় সেদিন সিদ্দিকবাজারে। র‍্যাবের ডগ স্কোয়াডের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক মেজর মোহাম্মদ এমদাদুল হক বলেন, ‘আমরা যেকোনো সময় যাতে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের ব্যবধানে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দিতে পারি সে রকম প্রস্তুতি রাখি। সেদিনও ফায়ার সার্ভিসের কল পাওয়ার মাত্র ১০ মিনিটের মাথায় আমরা রওনা দিই।’

সিদ্দিকবাজারের সেই বিধ্বস্ত ভবনে উদ্ধারকারীদের যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তাই উদ্ধারকারী কুকুর পাঠায় র‍্যাব। সেই উদ্ধারকারী দলে ছিল চিতা নামের ল্যাবরাডর জাতের কুকুর। কুকুরটির পরিচালনা করেন সৈনিক সজীব মিয়া। মিরপুরে র‍্যাবের ডগ স্কোয়াডের কার্যালয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তাঁর কথাতেও উঠে আসে বিস্ফোরণের ভয়াবহতা।

সজীব মিয়া বলেন, ‘সেই ভবনে আমরা অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করি চিতাকে নিয়ে। কিন্তু ভবনের ভেতরের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে কাচ আর ভাঙা স্যানিটারি সরঞ্জামের কারণে আমরা হাঁটতেও পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর একটা জায়গায় গিয়ে চিতা কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করে। আমার হাত চাটে। মানে বোঝাতে চাচ্ছিল, এখানে কিছু আছে।’ চিতা ভবনটির দুটি স্থানে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে বলে জানান সজীব।

সম্মাননার অংশীদার হয়েছেন ‘চিতার’ হ্যান্ডলার বা নিয়ন্ত্রক সৈনিক সজীব মিয়া

মেজর এমদাদুল বলেন, ‘চিতার চিহ্নিত করা সেই দুটি জায়গা থেকে ফায়ার সার্ভিস একজন ব্যবসায়ীসহ মোট তিনজনকে উদ্ধার করে। যেখানে এক জায়গা থেকেই দুজনকে পাওয়া যায়।’

উদ্ধার হওয়া তিনজনের একজন স্যানিটারি ব্যবসায়ী মমিনুদ্দিন সুমন। এই উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে পায়ে কিছুটা আঘাত পায় চিতা। তার দক্ষতায় তিনটি পরিবার পায় তাদের নিখোঁজ স্বজনের দেহাবশেষ।

চিতার এই সফলতাকে মূল্যয়ন করেছে র‍্যাব। ২০ মার্চ র‍্যাবের ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে র‍্যাব মেমোরিয়াল ডে-২০২৩ উপলক্ষে র‍্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে র‍্যাব মহাপরিচালকের দরবারে চিতাকে সম্মাননা দেওয়া হয়। বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য এই প্রথম র‍্যাব মহাপরিচালক পদক (সেবা) পেয়েছে ডগ স্কোয়াডের চিতা।

বিস্ফোরণস্থলে অভিযানে অংশ নেয় ‘চিতা’

এ সম্মাননার অংশীদার হয়েছেন চিতার হ্যান্ডলার বা নিয়ন্ত্রক সৈনিক সজীব মিয়া। তাঁদের পদক পরিয়ে দেন র‍্যাব মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন। এ সম্মাননা পেয়ে খুশি সজিব মিয়া। তিনি বলেন, ‘এ পদক একদিকে আমার কাজের গতিকে বাড়িয়েছে আবার ঘটনাস্থলে আমার কাজকে আরও বেগবান করবে।’

যুদ্ধক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখায় বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীতে কর্মরত কুকুরদের র‍্যাংক ব্যাচসহ নানা পদকে সম্মানিত করার রীতি আছে। তবে বাংলাদেশে এ প্রথম কোনো বাহিনীতে কর্মরত কুকুরকে পদক দেওয়া হলো বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

ডগ স্কোয়াডের প্রধান বলেন, ‘আমাদের কুকুরগুলোও যেহেতু র‍্যাবের সদস্য, তাদের নিজস্ব নাম আছে, তারা রেশনও পায়। যেহেতু বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রতিবছর মহাপরিচালকের পদক দেওয়া হয়। তাই মহাপরিচালক মনে করেন, সেই স্বীকৃতি এ কুকুরগুলোও পেতে পারে।’

তিন বছর আগে চিতার জন্ম হয় র‍্যাবের ডগ স্কোয়াডেই। এরপর দুই বছর ধরে তাকে প্রশিক্ষিত করছে সৈনিক সজীব। বিভিন্ন অভিযানেও যায় তাঁর সঙ্গে। সজীব বলেন, ‘কুকুরের সঙ্গে না থাকলে তার সঙ্গে যে বন্ধুত্ব হয়, সেটা কেউ বুঝবে না। চিতা আমার সঙ্গে খেলা করে, আবার দুষ্টুমিও করে। কিন্তু আমি রাগ করলে সে বুঝতে পারে।’

র‍্যাবের ডগ স্কোয়াডে কাজ করে মোট ৫৮টি কুকুর। নিয়মিত টহল, সুইপিংয়ের মাধ্যমে ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ প্রয়োজনমতো নানা অভিযানে অংশ নেয় তারা। এ ছাড়া কুকুরগুলোকে নিয়মিত প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যাচাই করা হয় তাদের সক্ষমতা।