নাফিসা আলিয়া নূহা আর নাফিয়া আলিয়া নাবা প্রজাপতির মতো ঝালর লাগানো একই রকমের হলুদ জামা পরেছে। পায়ে গোলাপি জুতা, হাঁটলে তাতে লাইট জ্বলে।
১৪ দিন বয়স থেকে তারা রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ)। শুরুতে ওয়ার্ডে, পরে ৬১৮ নম্বর ভিআইপি কেবিনে বেড়ে উঠেছে তারা। এখানেই হাঁটতে শিখেছে। কথাও বলতে শিখেছে। তারা এই কেবিনকেই ‘নিজেদের বাড়ি’ মনে করত।
আজ সোমবার ২ বছর ৭ মাস ২২ দিন বয়সে নূহা-নাবা হাসপাতালের ‘বাড়ি’ ছেড়ে কুড়িগ্রামে নিজেদের বাড়ি ফিরছে। নূহা ও নাবার জন্ম হয় মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো অবস্থায়। শরীরের পেছন ও নিচের দিকে থেকে যুক্ত ছিল তারা। দুজনের পায়খানার পথও এক ছিল। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এদের বলা হয় ‘কনজয়েন্ট টুইন পিগোপেগাস’। এ ধরনের জোড়া শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা দেশে এই প্রথম বলেই বলছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা।
চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রোপচারের পর থেকে নূহা ও নাবা আলাদা দুই শিশু। আজ সকাল ৯টার দিকে হাসপাতালের কেবিন ব্লকের ৬১৮ নম্বর ভিআইপি কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি পাল্টানোর মতো জিনিসপত্র সব বস্তায় ভরা হয়েছে। নূহা ও নাবা হেঁটে বেড়াচ্ছে। এই হাত ধরে দুই বোন হাঁটে তো একটু পরই মারামারি লাগে। একজন বাবার কোলে চড়লে অন্যজনও একই বায়না করে। তবে আগে যে বাবার কোল দখল করেছে, সে কিছুতেই সেখানে বোনকে ভাগ বসাতে দেবে না। নূহা তুলনামূলকভাবে শারীরিকভাবে বেশি সুস্থ, তাই সে বেশি হাসে। নাম জানতে চাইলে দুজনেরই দাবি তাদের নাম ‘নাবা’।
নূহা আর নাবা আনন্দে মেতে থাকলেও তাদের বাবা মো. আলমগীর হোসেন এবং মা নাসরিন আক্তার তেমনভাবে হাসতে পারছেন না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাঁরা যাত্রা করছেন। পরিবহনশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন আলমগীর হোসেন। হাসপাতালে মেয়েদের সঙ্গে থাকতে হয়েছে বলে চাকরিটা চলে গেছে। এখন বেকার। ২৬ শতক জমি বন্ধক রাখতে হয়েছে। জমি বন্ধকের দুই লাখ টাকা আর চার লাখ টাকা ঋণসহ মোট ৬ লাখ টাকার ধাক্কা। বাড়ি ফিরলেই এ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে। ১১ বছর বয়সী ছেলে নাফিউ হোসাইন পড়াশোনায় এক বছর পিছিয়ে গেছে। এখন সে পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। এ পর্যন্ত মেয়েদের ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় আটটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও একটি বাকি আছে।
নূহা-নাবার মা নাসরিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েরা আলাদা হবে, এটা তো চিন্তাতেই ছিল না। মেয়েদের হাত ধরে আজ বাড়ি যাচ্ছি, চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। প্রায় ৩২ মাস ধরে মেয়েরা জানত, এটাই তাদের বাড়ি। হাসপাতালের বাইরে তাদের নিয়ে মাঝেমধ্যে রমনা পার্ক আর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গেছি। প্রথম দিকে বাইরে নিলেই ভয় পেত।’
এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছেন নাসরিন আক্তার। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের পেটের মধ্যে পায়খানার রাস্তা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে যে ব্যাগটি ব্যবহার করতে হয়, তা কুড়িগ্রামে পাওয়া যায় না। এই ব্যাগ কিনতেই মাসে ১২ হাজার টাকা লাগবে। এক সপ্তাহ পরপর ব্যাগগুলো পাল্টে দিতে হয়। মেয়েদের বাবার চাকরি নেই। দেনা আছে অনেক। মেয়েদের প্রতিদিন মাংসসহ অন্যান্য খাবার খাওয়াতে হবে। কেউ যদি আমাদের মেয়েদের পাশে দাঁড়ান, তাহলে হয়তো আমরা কিছুটা স্বস্তি পাব।’
গতকাল রোববার বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। এতে বলা হয়েছে, বেলা তিনটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেবিন ব্লকের ষষ্ঠ তলায় গিয়ে দুই শিশুর চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়। পরে দুই শিশুকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
নূহা ও নাবা শুরু থেকেই হাসপাতালে ভর্তি ছিল বিএসএমএমইউর নিউরোসার্জারি বিভাগের স্পাইনাল নিউরোসার্জারি ডিভিশন প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেনের অধীনে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবশেষে এই দুই শিশু হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে, এটাই আমাদের সফলতা। মেরুদণ্ড জোড়া লাগানো থাকায় স্পাইনাল কর্ড আলাদা করাটাই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।’ তিনি জানালেন, আরেকটি অস্ত্রোপচার করা হবে। তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই পায়খানা করতে পারবে।
বিএসএমএমইউর সহ–উপাচার্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, এই দুই শিশু জোড়া লাগানো অবস্থায় হাসপাতালে এসেছিল। আজ একজন মায়ের কোলে আরেকজন বাবার কোলে চড়ে বাড়ি যাচ্ছে। এ পর্যন্ত এদের চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৫১ লাখ টাকা। ১৫ লাখ টাকা অনুদান ছাড়া বাকি টাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বহন করেছে। পরবর্তী চিকিৎসাতেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিশুদের পাশে থাকবে।
নূহা ও নাবার বাবা আলমগীর হোসেন একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে কুড়িগ্রামের দিকে রওনা দেন। ততক্ষণে নূহা ও নাবার আনন্দে খানিকটা ভাটা পড়েছে। কান্নাকাটি শুরু হয়েছে। তাদের নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার যে যুদ্ধ, তা শুরু হবে বাড়ি ফেরার পর।