২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথমা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ বইটিতে ৩৫৪ জন বুদ্ধিজীবীর জীবন-ইতিহাস ধারণ করা হয়েছে। বইটি প্রকাশে সহযোগিতা করেছে সিটি ব্যাংক।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল স্বপ্ন আর স্মৃতি থেকে। এই স্বপ্ন রচনা করতে বুদ্ধিজীবীরা ভূমিকা রেখেছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। এই বুদ্ধিজীবীদেরই নিশানা করে তালিকা করা হয় এবং ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তাঁদের হত্যা করে পাকিস্তানি সৈন্য এবং আলবদররা।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কাহিনি আমরা যত পড়ি, ততই শ্রদ্ধায় আনত হই, প্রতিজ্ঞায় শাণিত হই। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনকথা একটু স্মরণ করি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি কার্যবিবরণী উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখার প্রস্তাব করেন। সেখান থেকেই শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯৭১ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘এই মাটি ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।’ মার্চ মাসের শেষে তাঁকে ধরে নিয়ে গেল কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসে। অকথ্য অত্যাচার চলল তাঁর ওপর। তখন তাঁর বয়স ৮৫।
সেই বন্দিশালা থেকে আর ফেরেননি তিনি। আমরা স্মরণ করতে পারি মুনীর চৌধুরীর কথা। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক কারাগারে বন্দী অবস্থায় লেখেন ভাষা আন্দোলনের ওপরে নাটক কবর। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ তাঁকে ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদররা। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁর লাশ আর আলাদা করে শনাক্ত করা যায়নি।
অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীরা একটা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন রচনা করেছিলেন, সেই দেশটা কেমন হবে, তার রূপরেখাও তাঁরা তাঁদের কাজ, সক্রিয়তা ও লেখার মাধ্যমে সৃষ্টি করেছিলেন। ‘আজকে আকাশে-বাতাসে কবিতা নেই/ তবু ভালো লাগে হাসতেই, বাঁচতেই।’ লিখেছিলেন আনোয়ার পাশা, কবি ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই তিনি লিখেছিলেন উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত। সহজ–সরলভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বরে। ১৯৭১ সালে।
বিশ্ববিদ্যালয় আবাসন থেকে তাঁকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ঘাতকেরা। মিরপুরে বধ্যভূমিতে জলা-জংলায় পড়ে থাকে তাঁর লাশ। যেমন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এদেশীয় সহযোগীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, ফজলে রাব্বী, আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীন—নক্ষত্রপ্রতিম আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে। তালিকা ধরে ধরে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা দীর্ঘ। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে তথ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ নামে একটা বই প্রকাশ করে। সেখানে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ১ হাজার ৭০ জন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ প্রকাশ করে। এই বইয়ে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞা আরেকটু নির্দিষ্ট করা হয়, ২০১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম-পরিচয় কোষগ্রন্থটিতে ঠাঁই পায়। অনেকের ঠিকানা-তথ্য তত দিনে দুর্লভ হয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশ করে ১০ খণ্ডের স্মৃতি: ১৯৭১। ১০ খণ্ডে ২৩৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্মৃতিচারণা করেন নিকটজনেরা। প্রথমা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ বইটিতে ৩৫৪ জন বুদ্ধিজীবীর জীবন-ইতিহাস ধারণ করা হয়েছে। তাঁদের চমৎকার প্রতিকৃতিও ঠাঁই পেয়েছে বইটিতে।
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জাতির যে ক্ষতি হয়, যে মেধাশূন্যতা তৈরি হয়, তা আজও পূরণ হয়নি। তাঁরা ছিলেন আমাদের শ্রেষ্ঠ মানুষ। মুনীর চৌধুরীর মতো শিক্ষক, বাগ্মী, নাট্যকার, প্রগতিশীল কর্মী ও চিন্তাবিদ আমরা আর কোথায় পাব? কোথায় পাব শহীদুল্লা কায়সারের মতো বড়মাপের ঔপন্যাসিক–সাংবাদিককে? আলতাফ মাহমুদের মতো সংগীতজ্ঞ সুরস্রষ্টা কি আর আসবেন? ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুরটা যখনই বাজে, তখনই কি আমরা থমকে দাঁড়াই না, আমাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় ওই সুরের ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে না?
আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো কবিতার কথা, স্বাধীনতার কথা বলতে পারছি না! বলতে পারিনি। বুদ্ধিজীবীর কাজ হলো স্রোতের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলা। বুদ্ধিজীবী তিনিই, যিনি চিন্তার বিদ্রোহ করেন। জীবন দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাঁদের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি।
চেক লেখক মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, মানব ইতিহাসে ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। তাই আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না।
প্রথম আলো ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’ শিরোনামে রোজ একজন করে শহীদ বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে প্রথম আলো একাধিক উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘটনার দিনপঞ্জি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিচয় ও অবদান নিয়ে ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করা।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথমা প্রকাশন এখন পর্যন্ত ৮৪টি বই প্রকাশ করেছে। এই প্রয়াসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক পর্বগুলো নিয়ে সরাসরি যুক্তদের লেখা আছে। আছে মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন পর্বের ঐতিহাসিক আখ্যান। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক উপস্থাপন প্রথমা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছে। প্রথমা প্রকাশন, সিটি ব্যাংকের সহযোগিতায় প্রকাশ করেছে একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী: স্মৃতি জীবন যুদ্ধ বই দুটি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে লাজ্জাত এনাব মহছি, রাশেদুর রহমান ও আশীষ-উর-রহমান গ্রন্থিত এবং আনিসুল হক সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী বইটা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে সংগ্রহে রাখা উচিত বলে মনে করি। যদি বাংলাদেশ নামের জাহাজটি সঠিক বন্দরের দিকে নিয়ে যেতে হয়, বুদ্ধিজীবীরা সেখানে বাতিঘরের ভূমিকা পালন করতে পারবেন।