ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত শিশুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ঝুঁকিমুক্ত পেশায় সরিয়ে আনতে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প নেওয়া হয়।
রংপুরের পীরগঞ্জে কাদিরাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী রেজোয়ান হোসেন। গ্রামের সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পেশার সঙ্গে যুক্ত নয় সে। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সেই পেশা থেকে সরিয়ে আনতে সরকারের দেওয়া প্রশিক্ষণ তালিকায় তার নাম। ১০ মাস সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। প্রতি মাসে পেয়েছে এক হাজার টাকা করে শিক্ষাবৃত্তিও।
রেজোয়ানের বাবা আখতারুজ্জামান গরু ব্যবসার পাশাপাশি কৃষিকাজে যুক্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেকে সেলাই মেশিনের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অন্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিলে কাজে আসত। বাড়িতে সেলাই মেশিন নেই। যা শিখেছে, তা কাজে আসেনি। প্রশিক্ষণকালে ছেলেটা কিছু টাকাপয়সা পেয়েছে, এটাই লাভ হয়েছে।
এ প্রকল্পের নকশাতেই গলদ আছে। আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, দিই। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ দিয়ে কোনো কাজ হয় না।আশফাক সিরাজ, প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রিচিং পিপল ইন নিড
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত শিশুদের সরিয়ে ঝুঁকিমুক্ত কাজ করে আয়ের পথ করে দিতে ২০১৮ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২৮৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের নাম ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়)’। সরকারি তহবিল থেকে এর অর্থায়ন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় জরিপের মাধ্যমে ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১ লাখ শিশুকে নির্বাচিত করা হয়। এসব শিশুকে নয়টি বিষয়ের ওপর ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাসের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আগামী মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।
চতুর্থ পর্যায়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে কক্সবাজার ও ফরিদপুর পৌরসভা এবং রংপুরের হারাগাছ পৌরসভা ও পীরগঞ্জ উপজেলায় প্রকল্পের কাজ হয়। এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ২৫৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
নথি অনুযায়ী, জরিপের মাধ্যমে শিশুদের তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে এই প্রকল্পের কাজ পরিচালনায় ১১২টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে (এনজিও) নিয়োগ দেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। নির্বাচিত শিশুদের ২০টি তালিকা থেকে দৈবচয়ন–পদ্ধতিতে ২২টি শিশুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। দেখা গেছে, একটি শিশুও কোনোদিন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত ছিল না এবং এখনো নেই। তারা সবাই শিক্ষার্থী।
গত বছরের ২৬ জানুয়ারি সচিবালয়ে শ্রমসচিব এহছানে এলাহীর সভাপতিত্বে এ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) তৃতীয় সভায় শিশু জরিপ প্রতিবেদনের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন উপস্থিত কর্মকর্তারা। সভায় একটি উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, ‘অ্যাকশন ফাইভ’ নামের একটি এনজিও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে শিশুশ্রমিকদের ওপর জরিপ করে। তালিকায় ১ হাজারের বেশি নাম থাকলেও সেখান থেকে ৩৬৬ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা যায় মাত্র ২৫ জন এই প্রশিক্ষণ পাওয়ার যোগ্য।
বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তার বাবা সুজন খান জানান, ছেলে সেলাই মেশিনের ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছে। তবে তা কোনো কাজে আসেনি। অবশ্য নগদ ৯ হাজার টাকা পেয়েছে বলে জানান তিনি।
একই ঘটনা বরিশালের দক্ষিণ জাগুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার এবং চট্টগ্রামের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলামের ক্ষেত্রে। দুজনেই সেলাই মেশিনের ওপর প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এই প্রশিক্ষণ তাদের কোনো কাজে আসেনি। কাজে আসেনি ফাহিম খানের কম্পিউটারের ওপর নেওয়া প্রশিক্ষণও। সে ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এবার উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছে। তাই এখন সে কিছু করতে পারছে না। তবে আরেক শিক্ষার্থী ফরিদপুর পৌরসভার বাসিন্দা আরজু এ প্রকল্পের আওতায় সেলাই মেশিনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি এ বিষয়ে কাজ করছে বলে পরিবার জানায়।
প্রশিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত শিশুদের বদলে এত বেশি স্কুলশিক্ষার্থী কেন—সে প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, একজন শ্রমজীবী শিশুও এখানে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণের জন্য আসবে না। কারণ, এখানে শিশুদের মাসে এক হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। অন্য কোথাও কাজ করলে এর চেয়ে বেশি টাকা পায় তারা। তা ছাড়া ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী একজন শিশুশ্রমিকের জন্য মাত্র ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও চার মাসের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কোনো কাজে আসে না। এ কারণে শ্রমজীবী শিশুদের পাওয়া যায় না।
রিচিং পিপল ইন নিড (আরপিএন) নামের একটি এনজিওর করা তালিকায় স্কুলপড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর নাম এসেছে। এ বিষয়ে আরপিএনের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আশফাক সিরাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের নকশাতেই গলদ আছে। আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার, দিই। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ দিয়ে কোনো কাজ হয় না।’
২০১৩ সালে শিশুদের জন্য ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা নির্ধারণ করে দেয় সরকার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টেম্পোর হেলপার ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। রাজধানীতে ফার্মগেট থেকে নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা ও মিরপুর ২ নম্বর রুটে দিনে দেড় শতাধিক টেম্পো চলাচল করে। এগুলোর হেলপার (চালকের সহকারী) বেশির ভাগই ১৬ বছরের কম বয়সী শিশু।
১১ নভেম্বর ফার্মগেট এলাকায় কথা হয় এই কাজে যুক্ত পাঁচ শিশুর সঙ্গে। তাদের ম একজন ১৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ মিঠুন বলে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুদের সরিয়ে আনতে সরকারের নেওয়া কোনো প্রশিক্ষণের খবর তার জানা নেই। একই কথা বলে বাকি চার শিশুও।
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার সেলিম মোটরসাইকেল সার্ভিসিং সেন্টারে পাঁচ শিশু শ্রমিক কাজ করে। তারাও জানায়, জরিপের কাজে তাদের কাছে কেউ আসেনি। তারা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণও পায়নি।
শুধু যে এবারের প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে, তা নয়। প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়েও অনিয়ম ছিল। ২০১১ থেকে ২০১৪ মেয়াদে ‘ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসনের তৃতীয় পর্যায়ের’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয় ৬৮ কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশিক্ষণের আওতায় আসা বেশির ভাগ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল না।
প্রশিক্ষণ শেষে শিশুদের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে যোগসূত্র ও ফলোআপের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ ছাড়া মাত্র ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও চার মাসের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ শিশুদের কোনো কাজে আসেনি। কিন্তু চতুর্থ পর্যায়ের প্রকল্পে সেগুলোর কিছুই আমলে নেওয়া হয়নি।
এখন আবার জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে নতুন প্রকল্প নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এটি বাস্তবায়নে খরচ হবে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতের মতো এবারও বিপুল অঙ্কের এই টাকা অপচয় হবে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দেশে শিশুশ্রম পুরোপুরি বন্ধে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের অঙ্গীকার আছে। কিন্তু শিশুশ্রম বন্ধের প্রক্রিয়াটি বোঝা যাচ্ছে পুরোপুরি ত্রুটিপূর্ণ। পরিকল্পনাতেই অনিয়মের সুযোগ রাখা হয়। তিনি বলেন, শিশু শ্রমিকদের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে অনিয়মে এনজিওগুলোর যেমন দায় আছে, তেমনি মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারে না। ভবিষ্যতে এ ধরনের তালিকা তৈরিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আর এ জন্য অবশ্যই পুরো পদ্ধতি সংস্কার করতে হবে।