বাংলা একাডেমি
বাংলা একাডেমি

বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদে দীর্ঘদিন নেই নির্বাচিত সদস্য

বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে পদাধিকারবলের ও মনোনীত সদস্যদের দিয়ে চলছে। ফেলো ও সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে নির্বাচিত কোনো সদস্য অনেক দিন ধরে নির্বাহী পরিষদে নেই।

ফলে একাডেমিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা-পরামর্শ, বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদনসহ নির্বাহী পরিষদের কাজ গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

একাডেমির সাধারণ সদস্যদের অভিযোগ, উদ্যোগের অভাবে নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে অনিয়মের সুযোগ বাড়ছে।

অবশ্য একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, দীর্ঘদিন নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন না হওয়ার পেছনে রয়েছে একবারে অনেক সাধারণ সদস্য বানানোর ঘটনা। তবে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাহী পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

৩ বছর পরপর নির্বাচনের নিয়ম

বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, নির্বাহী পরিষদের সবশেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। তবে বাংলা একাডেমি আইন (২০১৩) অনুযায়ী, এই নির্বাচন ৩ বছর পরপর হওয়ার কথা। সে হিসেবে এত দিনে আরও ৮টি নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

বাংলা একাডেমি আইনের ২৩ নম্বর ধারাটি নির্বাহী পরিষদ বিষয়ের। এই ধারার ১ নম্বর উপধারা অনুযায়ী, মোট ১৯ সদস্য নিয়ে নির্বাহী পরিষদ গঠিত-পরিচালিত হবে।

৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচিত সদস্যরা নির্বাচিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাহী পরিষদের প্রথম সভার তারিখ হতে ৩ বছর মেয়াদের জন্য পরিষদের সদস্য হবেন। তাঁরা দুই মেয়াদের বেশি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন না।

নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচনের মাধ্যমে একাডেমির ফেলোরা তিনজন ফেলো ও সাধারণ পরিষদের সদস্যরা চারজনকে নির্বাচিত করবেন। এই সাতজনই নির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য।

কিন্তু এই সাত নির্বাচিত সদস্য না থাকায় অনেক দিন ধরে নির্বাহী পরিষদ চলছে শুধু পদাধিকারবলের ও মনোনীত ১২ সদস্য দিয়ে। এই ১২ জনের মধ্যে দুজন পদাধিকারবলের সদস্য। দুজন নির্বাহী পরিষদ মনোনীত সদস্য। আর আটজন সরকার মনোনীত সদস্য। অনেক দিন ধরে এই ১২ জনই নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা একাডেমির একজন ফেলো প্রথম আলোকে বলেন, একাডেমিতে অনেক সাধারণ সদস্য বানানোর ঘটনা শুধু একবার ঘটেনি। ফলে প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ধারা অনেক দিন ধরেই ব্যাহত হয়ে আসছে। এর প্রভাব পড়ছে বই প্রকাশনা থেকে শুরু করে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন, এমনকি একাডেমির নিয়োগ প্রক্রিয়ায়ও।

বাংলা একাডেমি

নির্বাহী পরিষদের কাজ

বাংলা একাডেমি আইনের (২০১৩) ২৪ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারায় নির্বাহী পরিষদের কার্যাবলির উল্লেখ আছে। এগুলো হলো একাডেমিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান। একাডেমির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রয়োজনে নীতিনির্ধারণ। সাহিত্য, সংস্কৃতি, গবেষণা ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। বার্ষিক প্রতিবেদন অনুমোদন। সরকার বা সাধারণ পরিষদ প্রদত্ত অন্য কোনো দায়িত্ব পালন। ২ নম্বর উপধারায় বলা আছে, নির্বাহী পরিষদ তার কার্যাবলির জন্য সাধারণ পরিষদের কাছে দায়ী থাকবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্বাহী পরিষদের একজন মনোনীত সাবেক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, সংকটটা উদ্যোগের অভাবের। উদ্যোগ নিলেই নির্বাচন করা সম্ভব। সম্প্রতি কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার তাঁর ২০১৪ সালে পাওয়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার ফেরত দেন। এরপর বাংলা একাডেমি নিয়ে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

গত ২৮ জানুয়ারি বাংলা একাডেমির কাছে নিজের পুরস্কারের অর্থ ও সম্মাননা স্মারক ফেরত পাঠান কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার। কারণ হিসেবে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা, দুই দশকের বেশি সময় ধরে নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন না করে ইচ্ছেমতো একাডেমি চালানোর জন্য প্রতিষ্ঠানটি সচেতন মানুষের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।

নির্বাচন কবে

বাংলা একাডেমি

দীর্ঘদিন ধরে না হওয়া নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন চলতি বছরের মধ্যে করার কথা বলছে বাংলা একাডেমি।

এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ২০২১ সালে একাডেমিতে আসার পরই নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। নির্বাচনের নীতিমালার খসড়া করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় নির্বাচনের বিধিমালা তৈরির জন্য কমিটি গঠন করেছে। চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন করার বিষয়ে তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। এ জন্য ভোটার তালিকা তৈরি করতে হবে।

নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন দীর্ঘদিন না হওয়া প্রসঙ্গে মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘এই সমস্যাটা ২০০১ সাল থেকে শুরু হয়েছে। নির্বাহী পরিষদের নির্বাচনে জয়ের জন্য তখন অল্প সময়ে অনেক মানুষকে একাডেমির সাধারণ সদস্য বানানোর ঘটনা ঘটেছিল। ফলে নির্বাচন প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি হয়। এ জন্য তখন নির্বাচন হয়নি। এরপর থেকে সেই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন পিছিয়ে যেতে থাকে। তবে সবকিছুর শেষ কথা, এ বছর আমরা নির্বাহী পরিষদের নির্বাচন করতে সব রকম উদ্যোগ নিচ্ছি।’

একাডেমির কাজের মান কমে যাওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘বর্তমানে লেখক, সাহিত্যিকের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ফলে কাজের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তবে কাজের গুণগত মানের সংকট আছে, এটি অস্বীকার করব না। পুরস্কার নিয়ে সমালোচনা আছে। কিন্তু এর মধ্য থেকেই অনেক গুণীজন বেরিয়ে আসছেন, যাঁদের কাজ সম্পর্কে আমরা জানতে পারছি।’

পুরো বিষয়টি জানিয়ে এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে ভাষাবিদ, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো এক আমলে অযৌক্তিকভাবে কিছু সদস্য করার ব্যাপারটি আমারও চোখে পড়েছে। এখন একাডেমির সামনে সুযোগ আছে অযোগ্য ও ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতিতে হওয়া সদস্যদের সদস্যপদ পুনর্বিবেচনা করার। এ উদ্দেশ্যে একাডেমির কাউন্সিল একটি সাব-কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সাধারণ সভার মাধ্যমে সদস্যপদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সদস্যপদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর নির্বাহী পরিষদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকবে না বলে আমি মনে করি।’