সেদিন ছিল শুক্রবার (১৯ জুলাই)। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর যেসব এলাকা বেশি উত্তাল হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল রামপুরা–বনশ্রী এলাকা। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া (৫১) ছুটির দিন হওয়ায় বাসায় ছিলেন। পরিবারের সদস্যরাও তাঁকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। মাসুদ পারভেজ নিজেও ফোন করে আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীদের সাবধানে থাকতে বলেন; কিন্তু তিনি নিজেই সন্ধ্যা সাতটার দিকে ছয়তলার বাসা থেকে নিচে নামেন। কিছুক্ষণ পর মাসুদ পারভেজের স্ত্রীর কাছে ফোন আসে। বাসার সামনে ভিড় করে আছেন একদল মানুষ। তাঁরা বলছিলেন, বনশ্রী প্রধান সড়কের পাশে ফরাজী হাসপাতালের সামনে ‘পুলিশ স্যার’কে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে।
মাসুদ পারভেজদের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মো. নুরন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন যাঁরা বাসার সামনে ভিড় করে ছিলেন, তাঁরা বলছিলেন, ‘পুলিশ পরিচয়’ পাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। মাসুদ পারভেজ পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলায় পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া (৫১) ছুটির দিন হওয়ায় বাসায় ছিলেন। পরিবারের সদস্যরাও তাঁকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন।
গত সোমবার দুপুরে বনশ্রী ই ব্লকে মাসুদ পারভেজের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ। তাঁর স্ত্রী মেরিনা আক্তার (বীণা) বললেন, যে মানুষটি নিজে ফোন করে সবাইকে সতর্ক থাকতে বললেন, তিনিই সতর্ক থাকতে পারলেন না। করুণ পরিণতির শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।
মেরিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৯ জুলাই রাত পৌনে আটটার দিকে একটি ফোন আসে তাঁর নম্বরে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, এই মুঠোফোন নম্বরের লোককে বনশ্রী প্রধান সড়কের সামনে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। পরিচয় জানতে চাইলে ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়। এমন অবস্থায় মেরিনা ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন। তাঁর স্বামীর আরেকটি মুঠোফোন দিয়ে নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ে তাঁর স্বামীর এক সহকর্মীর কাছে ফোন করে ঘটনা জানিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। এরই মধ্যে ভবনের সামনে লোকজন ভিড় করেন। তাঁরা বলেন, ‘পুলিশ স্যার’কে মেরে ফেলা হয়েছে। মাসুদ পারভেজকে এলাকার সবাই চিনতেন। তখন বাচ্চাদের নিয়ে বের হতে সাহস পাননি মেরিনা। পরে চার প্রতিবেশী বনশ্রী প্রধান সড়কে গিয়ে দেখতে পান, এক নারী রক্তাক্ত অবস্থায় মাসুদ পারভেজকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। ঘণ্টাখানেক পরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয়, মাসুদ পারভেজ ওই হাসপাতালে আছেন।
মেরিনা বলেন, বাইরে থেকে সিটি স্ক্যান করানো গেলে হয়তো তাঁর স্বামীকে বাঁচানো যেত; কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেন, বাইরে নেওয়ার মতো তাঁর স্বামীর শারীরিক অবস্থা নেই।
ওই রাতে বাচ্চাদের বাসায় রেখে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে যান মেরিনা। ভেতরে ঢুকে দেখতে পান, স্বামী লাইফ সাপোর্টে। মাথায়-পায়ে ব্যান্ডেজ, বুকসহ সারা শরীরে পেটানোর চিহ্ন।
মেরিনা বলেন, বাইরে থেকে সিটি স্ক্যান করানো গেলে হয়তো তাঁর স্বামীকে বাঁচানো যেত; কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেন, বাইরে নেওয়ার মতো তাঁর স্বামীর শারীরিক অবস্থা নেই।
দুই দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২১ জুলাই বেলা ১১টার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে মৃত্যু হয় মাসুদ পারভেজের। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কালান্দরে তাঁকে দাফন করা হয়। হামলাকারীরা মাসুদ পারভেজের কাছ থেকে দুটি মুঠোফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। ওই মানিব্যাগে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ও রেশন কার্ড ছিল।
এক নারী রক্তাক্ত অবস্থায় মাসুদ পারভেজকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। ঘণ্টাখানেক পরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয়, মাসুদ পারভেজ ওই হাসপাতালে আছেন।
মাসুদ পারভেজ-মেরিনা আক্তার দম্পতির দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে উম্মে মাইশা স্নেহা বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়েন। আরেক মেয়ে উম্মে মাহিরা নেহা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। আর ছেলে আহনাফ মাহিন ভূঁইয়া অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।
ছেলেকে প্রকৌশলী বানানোর স্বপ্ন ছিল মাসুদ পারভেজের। নিজের পরিবার চালানোর পাশাপাশি গ্রামে থাকা মাকেও খরচ দিতেন। এখন কীভাবে তাঁদের পরিবার চলবে, সন্তানদেরও কীভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নেবেন, তা ভেবে দিশাহারা মেরিনা আক্তার। এরই মধ্যে অবশ্য পুলিশের মহাপরিদর্শক তাঁদের জন্য আট লাখ টাকার এফডিআর করে দিয়েছেন।
এখন তিন সন্তানকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন মেরিনা আক্তার।
ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম
হত্যার ঘটনায় মামলা
২৩ জুলাই মেরিনা আক্তার বাদী হয়ে তাঁর স্বামী মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া হত্যার ঘটনায় খিলগাঁও থানায় মামলা করেন। এতে বলা হয়, বিএনপি, জামায়াত–শিবির, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অজ্ঞতানামা দুর্বৃত্ত ও বিক্ষোভরত দুষ্কৃতকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে মাসুদ পারভেজের ওপর হামলা চালায়।
ছেলেকে প্রকৌশলী বানানোর স্বপ্ন ছিল মাসুদ পারভেজের। নিজের পরিবার চালানোর পাশাপাশি গ্রামে থাকা মাকেও খরচ দিতেন। এখন কীভাবে তাঁদের পরিবার চলবে, সন্তানদেরও কীভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নেবেন, তা ভেবে দিশাহারা মেরিনা আক্তার।
মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ বিভাগ। মঙ্গলবার বিকেলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।