সুখবর

গুচ্ছগ্রাম থেকে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা 

মুন্সী সোহাগ হোসেন
মুন্সী সোহাগ হোসেন

বাবা ছিলেন দিনমজুর। শৈশব কেটেছে অভাব-অনটনে। নদীভাঙনে ভূমিহীন হয়ে সরকারি গুচ্ছগ্রামে বসবাস। সেখান থেকে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভারত সরকারের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে হয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা।

এই গল্প বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁয়ের এক তরুণের। নাম তাঁর মুন্সী সোহাগ হোসেন (২৭)। তিনি মাগুরা সদর উপজেলার হাজরাপুর ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা।

মাগুরা শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের ওই গুচ্ছগ্রামে সোহাগের জন্ম। নদীভাঙনের কারণে ভিটেমাটি হারিয়ে আশির দশকে নোয়াখালী থেকে মাগুরায় চলে আসে সোহাগের পরিবার।

সম্প্রতি হাজরাপুর গুচ্ছগ্রামে গিয়ে কথা হয় সোহাগ ও তাঁর স্বজনদের সঙ্গে। তরুণ এই উদ্যোক্তা জানান, বাবা মুন্সী আবুল হোসেন মারা গেছেন ২০১৭ সালে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে একমাত্র তিনিই লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছেন। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। আর বড় ও ছোট ভাই মিলে পুরোনো (ভাঙারি) জিনিসপত্রের ব্যবসা করেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে সোহাগের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। এরপর প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন ইছাখাদা শহীদ আবদুল মতলেব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পড়াশোনার জন্য ইটভাটাতেও কাজ করেছেন সোহাগ। ভ্যানও চালিয়েছেন। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছিলেন প্রথম। সোহাগ বলেন, ‘একসময় আমার দাদি ভিক্ষা করতেন। ছোটবেলায় কখনো ইটভাটায় ইট শুকানোর কাজ করেছি। ভ্যানচালক চাচার কাছ থেকে ভ্যান নিয়ে চালিয়েছি। ফলে আমি ভালো রেজাল্ট করলেও একধরনের মানুষ এটা মেনে নিতে চাইত না। কথা শোনাত। তখন মন ভেঙে যেত।’

২০১১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সোহাগ সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। তখন একটি কোচিং সেন্টার চালিয়ে নিজের খরচ জোগাতেন। এর মধ্যে ঢাকায় গিয়ে ইংরেজি দক্ষতার পরীক্ষা আইইএলটিএস দেন। ২০১৫ সালে অনলাইনে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন’ (আইসিসিআর) শিক্ষাবৃত্তির আবেদন করেন তিনি। ২০১৬ সালে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে গুজরাট প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পান সোহাগ। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

২০২০ সালে দেশে ফিরে চাকরি না খুঁজে নিজেই কিছু করার উদ্যোগ নেন সোহাগ। গড়ে তোলেন ‘পল্লি টেকস’ নামের একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় ইছাখাদা বাজারে ছোট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে করেছেন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। 

সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে শুনতাম, এ দেশে ভালো কোথাও পড়ালেখা করলে সবাই বিদেশে চলে যায়। আমার অনেক বন্ধুও বিভিন্ন দেশে স্থায়ী হচ্ছে। তবে আমার দেশে কিছু করার প্রবল ইচ্ছা ছিল। বিশেষ করে আমি যেহেতু গ্রামে বড় হয়েছি, সেখানে কিছু করার। এ জন্য আমার প্রতিষ্ঠানের নাম পল্লি টেকস।’

সোহাগের প্রতিষ্ঠানে মূলত সফটওয়্যার তৈরির কাজ করা হয়। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা ম্যানেজমেন্টের কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পভিত্তিক কাজের জন্য তাঁদের আটজন প্রকৌশলীর একটি বৈশ্বিক দল আছে, যাঁরা সবাই গুজরাটে সোহাগের সঙ্গে পড়াশোনা করতেন। এ ছাড়া সোহাগের সঙ্গে খণ্ডকালীন কাজ করেন তাঁর এলাকার অন্তত পাঁচজন শিক্ষার্থী।

করোনার মধ্যে কাজ শুরু করা সোহাগের আয় এখন মাসে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। নিজে আয় করে দুই বছর পরিবারকে সহযোগিতা করছেন তিনি। গুচ্ছগ্রামের ভাঙাচোরা ঘর সংস্কার করে আধা পাকা বাড়ি বানিয়েছেন। সোহাগের মা ছখিনা বেগম বলেন, ‘বাড়ি ছিল না। কষ্ট করিছি অনেক। এমনও সময় গেছে ছেলে কইছে খাতা–কলম লাগবি, পরীক্ষার ফি লাগবি, দিতি পারিনি। এখন ইঞ্জিনিয়ার হইছে। টুকটাক যা আয় করে নিজে চলে, সংসারেও দেয়।’ 

সোহাগ প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গিয়ে প্রথমে তাঁদের কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর কীভাবে প্রযুক্তি দিয়ে মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়, সেটা দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সফটওয়্যার বানান। নামমাত্র মূল্যে তাঁরা উদ্ভাবনগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। সুযোগ পেলে আরও বড় পরিসরে কাজ করতে চান তিনি।

মাগুরা জেলার বেশ কয়েকটি সরকারি দপ্তরে সোহাগের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। গত দেড় বছরে প্রশাসনিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পৌরসভা ব্যবস্থাপনা সহজ করতে কয়েকটি সফটওয়্যার বানিয়েছেন তিনি। গত বছর তিনি সদর উপজেলা প্রশাসনের জন্য ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মান উন্নয়ন মডেল’ নামে একটি তথ্য ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার বানান। যা দিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

এ ছাড়া চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে শ্রীপুর উপজেলায় ‘দরজায় সরকার’ নামে একটি সফটওয়্যার বানিয়েছে সোহাগের প্রতিষ্ঠান পল্লি টেকস। যেখানে ওয়েবসাইট ও অ্যাপের মাধ্যমে জনগণ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ, জিজ্ঞাসা, বিচার, প্রস্তাব জানাতে পারবেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা পৌঁছে যাবে দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছে। সম্প্রতি মাগুরা পৌরসভার স্টোর ও বাজার ডিপার্টমেন্ট ডিজিটাল করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগ ডিজিটাল করতে দুটি সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।

মাগুরার সদ্যসাবেক জেলা প্রশাসক আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তরুণ উদ্যোক্তা সোহাগের গল্পটা অনুকরণীয়। গুচ্ছগ্রামে বড় হয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পর তিনি আবার গ্রামে ফিরে এসেছেন। তাঁর মাধ্যমে সরকারের দুটি কাজ করিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি সফটওয়্যারের কাজ চলছে। যেটা বাস্তবায়িত হলে জেলার প্রত্যেক শিক্ষকের হাজিরাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কার্যালয়ে বসেই দেখতে পারবেন। তাঁর মতো এমন উদ্যোক্তা আরও তৈরি হলে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির লক্ষ্য দ্রুত বাস্তবায়িত হবে।