অলংকরণ : আরাফাত করিম
অলংকরণ : আরাফাত করিম

একাত্তরে কেন ফিরে যাই

ইতিহাসের মতো আর কোনো অধীত বিষয় তার দরজা সাধারণ পাঠকের জন্য এতটা অবারিত রাখে কি না, এই প্রশ্ন কেউ কেউ তুলেছেন। এর একটি কারণ, ইতিহাসের সঙ্গে প্রতে৵ক মানুষের সম্পৃক্ততা। ইতিহাস একটি চলমানতার নাম। এটি কাউকে অতিক্রম করে যাওয়ার কথা নয়। এই মুহূর্তে যেখানে যা ঘটছে, তার সঙ্গে সেসব জায়গার মানুষের একটা সম্পর্ক কোনো–না–কোনোভাবে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সমস্যাটা দেখা দেয় সেই ইতিহাস লিখিত রূপ নিলে। ইতিহাস লেখার সঙ্গে ক্ষমতার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। ফলে লিখিত ইতিহাস ক্ষমতার পছন্দের ওপর আলো ফেলে। ইতিহাসের সুনির্দিষ্টতা-অনির্দিষ্টতার অঞ্চলগুলো এভাবে নির্ধারিত হয়। যেসব অঞ্চল অনির্দিষ্ট থেকে যায়, সেসব নিয়ে ক্ষমতার আগ্রহ থাকে না। অথবা বিষয়টি এভাবেও বলা যায়, এক সময়ের সুনির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল ক্ষমতার পরিবর্তন অথবা পছন্দের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো সময় অনির্দিষ্ট হয়ে যেতে পারে, যেমন অনির্দিষ্ট অঞ্চলেও একসময় পড়তে পারে কিছু আলো। ইতিহাসের পালাবদল বলে যে কথাটি আমরা শুনি, তার একটি ব্যাখ্যা ইতিহাসের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্কের এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া যেতে পারে।

একাত্তরে আমি ফিরে যাই সেই অন্তঃস্রোতের উৎসমুখটি আরেকবার দেখে আসতে। অন্তঃস্রোতটি যদি অনুভব করা যায়, তাহলে এটি কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে, কোন সে কালমোহনায়, তা–ও অনুমান করা যাবে।

এ রকম একটি প্রয়াস দেখা যায় গত বছরের জুলাই মাসে প্রয়াত চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরার দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং–এ (১৯৭৯)। উপন্যাসটির শুরুতে দুজন শক্তিধর কমিউনিস্ট নেতাকে একটি প্রাসাদের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, ক্ষমতার চোখে অবাঞ্ছিত হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের একজনকে ইতিহাস থেকে নির্বাসন দেওয়া হয়। ব্যালকনিতে দাঁড়ানো দুজনের ছবি থেকে ওই পরিত্যক্ত বলে বিবেচিতজনকে মুছে ফেলা হয়। গল্প শুরুর কয়েক পাতা পর এসে কুন্ডেরা লিখেছেন, ‘(সালভাদোর) আয়েন্দের হত্যাকাণ্ড দ্রুতই বোহেমিয়ায় রাশিয়ার আগ্রাসনের স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়, বাংলাদেশের রক্তাক্ত গণহত্যা আয়েন্দেকে ভুলে যেতে দেয়, সাইনাই মরুভূমির যুদ্ধনিনাদ বাংলাদেশের কাতর গোঙানিকে ছাপিয়ে যায়, কম্বোডিয়ার গণহত্যা সাইনাইকে ভুলিয়ে দেয়...’ (ফেবার অ্যান্ড ফেবার, ১৯৯৬, পৃ. ৯-১০)।

কুন্ডেরাকে উদ্ধৃত করার প্রধান কারণ বাংলাদেশকে তাঁর বৈশ্বিক ইতিহাসের স্মৃতিবিভ্রমের উদাহরণ হিসেবে নেওয়া। ১৯৭১ সালে বিশ্বক্ষমতা যাদের হাতে ছিল, তারা বাংলাদেশের পক্ষে ছিল না, আমাদের এই সময়ে তারা যেমন গাজার পক্ষে নেই। গাজায় যা ঘটছে, সেসব দেশের মিডিয়ায় তা এখন নিয়মিতভাবে উপেক্ষিত। বিশ্বক্ষমতা যদি কোনো কারণে গাজার দিকে চোখ ফেরায়, দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। তবে সেই ‘যদি’ এখনো এক অসম্ভাবনার নাম।

দুই

আমার এ লেখাটি ইতিহাসের দর্শনগত কোনো সমস্যা নিয়ে নয় বা ইতিহাসের পক্ষ-প্রতিপক্ষ নির্ধারণের মতো জটিল প্রসঙ্গ নিয়েও নয়। এর মূল চিন্তাটি ১৯৭১ সালের সেই রক্তঝরা নয়টি মাস নিয়ে এবং ৫৩ বছর পর কেন সেই সময়ে ফিরে যাই, যেতে হয়—সেই প্রশ্নের একটি জবাব তৈরির জন্য। কিছু ইতিহাস আমরা অন্যের থেকে শুনি, বইয়ে পড়ি, ছবিতে দেখি; কিছু ইতিহাস মানুষের স্মৃতিতে এমনভাবে গাঁথা হয়ে যায় যে ঘুরেফিরে এর প্রকাশ ঘটে নানা বয়ানে, গল্পে, নির্মাণে। স্মৃতিবাহিত ইতিহাস রূপ নিতে পারে মিথে, রূপকথায়। ফলে এর সুনির্দিষ্টতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তা হতেই পারে কারণ, লিখিত ইতিহাসেও এই মিথ-রূপকথার উপস্থিতি যে থাকে না, তা নয়। মানুষ তার জীবনকালে কিছু ইতিহাসের সাক্ষী হয়, যার সুনির্দিষ্টতা থাকে প্রশ্নাতীত।

একাত্তরের ইতিহাস আমার কাছে এই তিনভাবেই ধরা দেয়। সেই রক্তঝরা নয় মাস আমি বাংলাদেশেই ছিলাম। চোখ–কান খোলা রেখেই চলতে হতো ওই নয় মাস। তাই এর ইতিহাসের অনেক কিছুই সুনির্দিষ্ট ছিল। অনেক কিছুই, অর্থাৎ সেই নয় মাসের অল্পখানি অংশের অনেক কিছুই আমার কাছে দৃশ্যমান ছিল। বাকি অংশটি এতই বিশাল ছিল যে তাকে বোঝা, তার অভিঘাত অনুধাবন করা ছিল দুরূহ একটি কাজ। সেটিও সম্ভব হয়েছে ওই ইতিহাসের কালেক্টিভ বা সামূহিক একচি চরিত্র তৈরি হয়ে যাওয়ায়। আমি জানি, একাত্তরে আমার দেখা সেই ক্ষুদ্র অঞ্চলটি প্রকৃতই ছিল বৃহৎ সেই অংশটির যাকে ‘একাত্তর’ নামের এক চাদর-আখ্যানের নিচে শুরু থেকে আমরা উপস্থাপন করছি ঘনিষ্ঠ প্রতিফলন। সারা বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে ভালো-মন্দের, গৌরবের-গ্লানির, বীরত্ব-কাপুরুষতার—তার প্রতিফলন এর সর্বত্রই পড়েছে। এ কারণেই সময় যত গেছে, একাত্তরের ইতিহাসটার একটা বিবর্তন বা রূপান্তরও ঘটেছে। এই রূপান্তরিত ইতিহাস লোকমানসে একটা জায়গা করে নিয়েছে। কখনো মিথ হিসেবে, কখনো গাথা অথবা একটা উজ্জ্বল ছবি হয়ে থেকে গেছে। একটা সময় কিছু বিষয় ভেবে কষ্ট হতো। যেমন একাত্তরকে কীভাবে অবহেলা করা হচ্ছে, এর ইতিহাস ধরে টান দেওয়া হচ্ছে, একাত্তরকে কুন্ডেরা কথিত সেই ব্যালকনি-মুহূর্তের মতো এয়ারব্রাশিংয়ের শিকার করা হচ্ছে, যাতে জ্যান্ত ছবি মুছে ফেলা হয়েছে, তার জায়গায় বরং জুড়ে দেওয়া হয়েছে একাত্তরে মানুষের কাছে অবাঞ্ছিত কারও ছবি।

এখনো যে কখনো কোনো কোনো বিষয় নিয়ে কষ্ট হয় না তা নয়, যেমন ‘একাত্তরের চেতনা’ বিষয়টি যখন উপহাসে পরিণত হয়, যার পেছনে থাকে অপরাজনীতি সেই অপরাজনীতি যা ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অথবা ক্ষমতায় যেতে না পারার আক্ষেপ থেকে প্রকাশ্য হয়। তবে লোকমানস কথাটিতে আমার আস্থা আছে বলে, কুন্ডেরা–বর্ণিত ইতিহাসের পালাবদলের বিষয়ে মোটামুটি অবহিত আছি বলে বিশ্বক্ষমতার সঙ্গে ইতিহাসের সুনির্দিষ্টতা-অনির্দিষ্টতার জড়িত থাকার বিষয়টি জানি বলে এখন সেসব নিয়েও ভাবি না।

একাত্তর আমার কাছে এমন এক সময়, ইতিহাস, শক্তি এবং লোকপ্রত্যয়ের নাম, যা এক তীব্র অন্তঃস্রোতের মতো রয়ে যায়, যার প্রভাব বুঝতে হলে একটু গভীরে যেতে হয়। যারা একাত্তরের মনগড়া ইতিহাস তৈরি করেন, তাঁরা সেই গভীরে পা রাখেন না, রাখার ইচ্ছাও তাঁদের আছে বলে মনে হয় না। তাঁরা থাকেন তাঁদের ক্ষমতার ভোগকর্মে অথবা ক্ষমতায় না থাকার হতাশায়।

সময়ের তীব্র অন্তঃস্রোতের উপমাটিও আমার মাথায় এসেছে এক ভাদ্রে ফেরিতে পদ্মা পার হতে গিয়ে। ভাদ্রের পদ্মা ভরা নদী। তারপরও বিশাল যান্ত্রিক ফেরি তাকে কাবু করার কথা। কিন্তু এগোতে প্রচুর বেগ পেতে হচ্ছিল। ফেরির চালককে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি সেই অন্তঃস্রোতের কথা বলেছিলেন। ‘বাইরে কী আর দেখছেন,’ তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘একটু গভীরে গেলে টের পাবেন, পদ্মাকে কেন কীর্তিনাশা বলে।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই অন্তঃস্রোত তৈরি হয় মানুষের ইচ্ছাশক্তিতে, কর্ম এবং উদ্যমে, তাদের আত্মপ্রত্যয়ে। একাত্তরে সেটি তৈরি হয়েছিল। এটি থাকবে, কারণ এটি বদলানো কোনো ক্ষমতার এমনকি বিশ্বক্ষমতার সাধ্য নেই। গাজায় সেই অন্তঃস্রোত তৈরি হচ্ছে, অথবা আছে এবং নতুন করে অনুভূত হচ্ছে, যার অভিঘাত বিশ্ব অনুভব করছে। সেদিন সিএনএনের এক প্রতিবেদক জানান, গাজায় যে প্রতিরোধ তিনি দেখেছেন, তা অবিশ্বাস্য। এটি আছে বলেই ফিলিস্তিনের মানুষ টিকে আছে, সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। এটি আছে বলেই এখন পশ্চিমের অনেক শহরে মানুষ গাজাবাসীর পক্ষে নামছে। একাত্তরের অন্তঃস্রোত আমাদের দেশটাকে সামনে নিয়ে যাবে, তবে সেই সামনে নেওয়া অর্থনীতি আর প্রবৃদ্ধির সূত্র মেনে নয়, এই এগিয়ে নেওয়ার চরিত্রটি জাতিসত্তার স্ফূরণের এবং তার শক্তির উদ্​যাপনের সমান্তরাল এক অনিবার্যতা।

একাত্তরের বেশ কয়েক বছর পর আমি সুন্দরবনে গিয়ে এক বাঘের গল্প শুনেছিলাম, যে বাঘটি একাত্তরে একজন মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় নেমেছিল। সেই গল্প এত দিনে মানুষ মনে রেখেছে কিনা জানি না, কিন্তু এসব গল্প মানুষের স্মৃতিতে প্রজন্মক্রমে জমা থাকে, সুন্দরবনের গাজি যেমন আছেন মানুষের স্মৃতিতে, শিল্পীর জড়ানো পটে। এবং স্মৃতিতে তাঁদের নানা রূপান্তর ঘটে। একটা তলে সেসব স্মৃতি বিশ্বস্ত যাকে সেই অন্তঃস্রোতের কাছে, যার অস্তিত্বটি একটু গভীরে না গেলে অনুভব করা যায় না।

এক মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছিলাম, যিনি বাস্তব জীবনে ছিলেন ভুলে যাওয়ার মতো নিরাকর্ষণ ও উদ্যমহীন একজন মানুষ। অন্তত তাঁর স্ত্রী সে রকমই তাঁকে দেখতেন। অথচ একাত্তর তাঁর বীরত্ব ও আত্মত্যাগ দেখল। তাঁর রূপান্তর ঘটাল এক সুপুরুষে, যিনি হাঁটেন মেঘে মাথা রেখে। ওই স্ত্রী যদি গত হয়ে যান, সেই মুক্তিযোদ্ধার গল্পটা কি হারিয়ে যাবে? সহজ উত্তর, হ্যাঁ। কিন্তু অন্তঃস্রোতের খবর যে রাখে, তার কাছে হারাবে না। এই রূপান্তর, এই জীবন থেকে মিথে পরিণত হওয়া, এগুলো ছোটখাটো ঘটনা নয়। এগুলোর রসায়ন-বর্ণনাও সহজ নয়।

তিন

প্রতিবছর ২৫ মার্চ গভীর হওয়ার পর বাতাসে কান পাতলে কালরাত্রির নানা শব্দ শোনা যাবে। সেই রাত একদিকে ছিল বীভৎসতায় মোড়ানো। অন্যদিকে অসংখ্য মানুষের জীবন মুহূর্ত-সময়ে হারিয়ে যাওয়া, স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার আঘাতে বিপর্যস্ত। কিন্তু সেই রাতের গায়ে শহীদেরা তাঁদের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কথাটি লিখে দিলেন। ২৫ মার্চের রাতজুড়ে যে দীর্ঘশ্বাস, কান্না, ক্রোধ ও প্রতিজ্ঞার গর্জন শোনা গিয়েছিল, একাত্তরজুড়ে চলল তার পুনরাবৃত্তি। গর্জনের শব্দ শত্রুকে বিচলিত করল, তাদের আত্মবিশ্বাস তলানিতে নিয়ে গেল। শত্রুরা ইতিহাসটিকে তাদের মতো করে তৈরি করে নিতে চেয়েছিল। সেই কাজে তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য বিশ্বক্ষমতাও আস্তিন গুটিয়ে নেমেছিল। কিন্তু একাত্তরের অন্তঃস্রোত তার সলিলসমাধি ঘটাল।

একাত্তরে আমি ফিরে যাই সেই অন্তঃস্রোতের উৎসমুখটি আরেকবার দেখে আসতে। অন্তঃস্রোতটি যদি অনুভব করা যায়, তাহলে এটি কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে, কোন সে কালমোহনায়, তা–ও অনুমান করা যাবে। তবে সেই স্রোত যাদের সেই মোহনায় নিয়ে যাবে, তারা যদি দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে, নানা রকম রঙিন পর্দায় দৃষ্টি মেলে, অপরাজনীতির চোরাবালিতে সেঁধিয়ে গিয়ে, তাকেই নিয়তি মেনে, নিষ্ফল তর্কে শক্তি ক্ষয় করে, তাহলে সেই স্রোত বয়ে যাবে কার জন্য? একাত্তরে বাংলাদেশের ভূগোল আর ইতিহাস, জীবন আর জলবায়ু ছিল এক এবং অবিভাজ্য কিছু ভগ্নাংশ মানুষ এবং তাদের আলাদা ইতিহাস, জলবায়ু ইত্যাদি বাদ দিলে। মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষার ঘোরতর ঘাটতি ছিল। কিন্তু একটা জায়গায় তারা ছিল এক এবং তা স্বাধীনতার প্রশ্নে। শীর্ণ বাহু, বলহীন এসব মানুষ এস এম সুলতানের মানুষদের মতো পেশিবহুল আর সবল হয়ে উঠল, কোন সে রসায়ন? একাত্তরে ফিরে গেলে আমি বুঝি, সেই রসায়ন তৈরি করেছিল নেতৃত্ব, যার উদাহরণ তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তাঁর চার সহযোগী এবং অন্যান্য মানুষের অজটিল জীবনপ্রবাহ, রাজনীতির তুলনামূলক সুস্থতা, বাইরে থেকে আসা নানা মতাদর্শের অনুপস্থিতি, স্বার্থপরতা আর লোভের মাত্রা ছাড়িয়ে না যাওয়া।

সময়টা আগে থেকেই কোনো স্বর্ণযুগ ছিল না, দেশটাও কোনো ইউটোপিয়া ছিল না। কিন্তু সময়টা ছিল হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়ানোর। ওই একটা সময়ই। এবং ওই সময়টাই তৈরি করে দিয়েছিল একাত্তরের অন্তঃস্রোত। মানুষগুলো নেই অথবা তাদের বৃহৎ অংশই নেই, কিন্তু স্রোতটা আছে। দুঃখের বিষয়, এই স্রোতটাকে খুঁজে নেবে, তেমন মানুষ এখন আর নেই।

এ সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেকেই যেন নিজের হাতটা নিজের কাছে রেখে দিচ্ছে, অন্যের দিকে বাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা কারও নেই। যদি দিতেই হয়, সেটি ভেবে হাতের গোপনে একটা ছুরি রেখে দিচ্ছে।

এ বছর ২৬ মার্চ উদ্​যাপিত হবে রমজানে। বাজারটা একটু ঘুরে আসুন। এই মাসকে আমরা বলি সংযমের মাস। ছেলেবেলায় আমাদের বলা হতো, এই মাসে খেতে হবে অর্ধেক, কাজ করতে হবে দ্বিগুণ। সে না হয় হচ্ছে না, কিন্তু বাজার কেন সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে? যদি এই সংযমের মাসে কিছু মানুষ তাদের লোভের আগুনে নিচু আর নিচু-মাঝারি আয়ের অসংখ্য মানুষের কপাল পোড়ায়, তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়ায়? বিশ্বের অসংখ্য দেশে ধর্মীয় উৎসবের আগে বাজারে জিনিসের দাম কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে হয় তার উল্টো। এই দেশে অপকর্ম যে কত রকমের হয়, তার সংখ্যা নেই। আমরা কৃপাহীনভাবে মানুষ খুন করি, নদী-বিল-টিলা-জঙ্গল খুন করি, বিদেশে টাকা পাচার করে নিজস্ব স্বর্গ গড়ে তোলার স্বপ্নে ব্যস্ত থাকি। অথচ মা বলে যে দেশটিকে সবাই ডাকি, সেই দেশটার সর্বনাশ করতে সারাক্ষণ দৃঢ়সংকল্প থাকি।

এটি যদি একটি অসুখ হয়, তাহলে এর নিরাময় কী? উত্তরটা জানা নেই, তবে আন্দাজ করতে পারি। নিরাময়টা কী, তার ধারণা পাওয়া যাবে যদি একাত্তরের অন্তঃস্রোতটাকে অন্তত বুঝতে পারি। আর যদি সেই স্রোতটাকে একবার হাত রাখতে পারি, নিরাময় অসম্ভব নয়।

প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ তৈরি কি না।

চার

একাত্তরে আমি ফিরে যাই; কারণ, আমি বিশ্বাস করি, একাত্তরে যেমন আমাদের একটাই ভূগোল ছিল, জলবায়ু ছিল; এখনো তেমনই থাকার কথা। তবে ফারাকটা এই—এই ভূগোল শতবিচ্ছিন্ন; এবং তা করেছি আমরাই। জলবায়ু দূষিত, তা করেছি আমরাই।

এই শতবিচ্ছিন্ন ভূগোল এবং ক্লান্ত-দূষণপীড়িত জলবায়ু (যাতে আছে রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক জলবায়ুও) নিয়ে আমাদের স্থায়িত্ব বেশি দিনের হবে না। এ নিয়ে বিদেশেও আমরা কোনো স্বর্গ খুঁজে পাব না। কারণ, সেই স্বর্গে যখন আমরা যাব, দূষণ নামের আমরাই তো যাব, নাকি! একাত্তরে আমি ফিরে যাই এই দূষণমুক্তি, শতছিন্নতা থেকে মুক্তির একটা পথ খোঁজার জন্য। সেই পথটা যে চলে একাত্তরের অন্তঃস্রোতের হাত ধরে, লোকমানসের কিছুটা হদিস জানি বলে সেটা আন্দাজ করতে পারি।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরেটাস অধ্যাপক; কথাসাহিত্যিক