এপ্রিল ২০২৩-এ ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে শেষবারের মতো পাশাপাশি দুই বন্ধু—লেখক ও নুরুন্নাহার
এপ্রিল ২০২৩-এ ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে শেষবারের মতো পাশাপাশি দুই বন্ধু—লেখক ও নুরুন্নাহার

স্মরণ

চিরসখা নুরু

মাক্কী (হোসনে আরা) আমার পরম বন্ধু। মাক্কীর সূত্রেই ওর খালাতো বোন নুরুকে পেয়ে যাই। দিনে দিনে প্রগাঢ় হয়ে ওঠে মমতায় মাখা স্নিগ্ধ মানুষটির সঙ্গে বন্ধুত্ব।

নুরুর (নুরুন্নাহার আবেদীন) সঙ্গে আমার আবার কলেজের সূত্রেও যোগাযোগ ছিল। ওদের বাড়িতে খুব বেড়াতে যেতাম। নুরুর স্বামী ভাইজান একদিন আমাকে বললেন, তোমার বন্ধু তো ঢাকা কলেজের ল্যাবরেটরিতে ব্যাঙ কেটে ওই হাতে আর খেতে পারে না, তুমি ওকে সাহায্য করতে পারো না? তখন থেকেই, ঢাকা কলেজ সেরে নুরু ইডেন কলেজে ফিরলে, ওকে আমি দুপুরের টিফিন খাইয়ে দিতাম। কলেজে যে সামান্য কজনের সঙ্গে ভালো জানাশোনা হয়েছিল, তাদের মধ্যে নুরুর সঙ্গেই ভাবটা ছিল বেশি। সেটা ওদের গোটা পরিবারের সঙ্গেই বন্ধুত্ব গভীর হওয়ার অন্যতম কারণ।

ওদের বাড়িতে আমি একের পর এক গান গেয়ে যেতাম। মাক্কীদের মতোই ওরা সবাই–ই গানপাগল। ওদের আনসারী ভাইও অনেক গান গাইতেন। নুরুরা সবাই ওনার মহা ভক্ত। উনি পুরোনো বাংলা গান, সিনেমার গান গাইতেন। নুরুদের ৩ নম্বর পুরানা পল্টনের বাড়িতে জমজমাট গানের আসর বসত।

পরে ওরা সরকারি কোয়ার্টারে উঠে যায়। ওই সব জায়গা ঘিরেই নুরুকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। তখন আমিও আজিমপুরের সরকারি কলোনিতে থাকি। ওর স্নিগ্ধ স্বভাবের টানে ওর কাছ খুব যেতাম। নুরুর কাছে চুপচাপ বসে থাকতেও খুব ভালো লাগত। দাদা সাইফুদ্ দৌলাও সেখানে এসে উপস্থিত হতেন।

ছেলেপুলে নিয়ে মাক্কী বরাবরই ছায়ানটের সব অনুষ্ঠানের সাজসজ্জায় মেতে উঠত, মঞ্চের আড়ালের আয়োজনের কাজেও হাত লাগাত। ওদের সঙ্গে নুরুও সপরিবার সবেতে জড়িয়ে পড়ে। স্নিগ্ধতা, কোমলতা আর সুরুচিপূর্ণ পরিপাটি স্বভাবের গুণে আমাদের ভরসা হয়ে ওঠে আমার বন্ধুটি।

শুধু অনুষ্ঠান সাজিয়ে তোলা কেন, ছায়ানটের নানান রিহার্সালেও আমরা নুরুর বাড়ির বৈঠকখানাটি ব্যবহার করতাম। কারও বাড়িতে দল বেঁধে গান নিয়ে বসা মানে সেই গৃহকর্তারই জলখাবারের আয়োজন। হাসিমুখে, অক্লেশে সব সামলে নিয়েছে নুরু।

ছায়ানটের কাজে দেশের বাইরের বড় শিল্পী এলে তাঁদেরও স্থায়ী ঠিকানা ও সঙ্গী হয়ে ওঠে নুরুর বিশাল বাড়ি আর ওর পরিবার। যেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, শঙ্খ ঘোষ, সর্বাণী হোমের বাংলাদেশের ঘর।

একের পর এক মাক্কী, দাদা ও নুরুকে হারিয়ে আমাদের জীবনের একটা দিক যেন অন্ধকার হয়ে গেছে (গত ১১ আগস্ট প্রয়াত হন নুরু)। ৫ নম্বর ধানমন্ডির ৫০ নম্বর বাড়িটিও কি আলো হারাচ্ছে? নির্মোহ ভালোবাসায় বেঁধে অগণ্য অনুসারী রেখে গেছেন ওঁরা। আমার এবং ছায়ানটের চিরসখা হয়ে ওঠা নুরুর আন্তরিকতা-নিষ্ঠা-নিভৃতকর্মের স্মৃতিই হয়তো সে ফিকে আলোয় আবার ঔজ্জ্বল্য ফেরাবে!