রক্তমাখা ছুরি! মানুষের রক্তমাখা ছুরি! অফিসের সিঙ্কে একটা মানুষের রক্তমাখা ছুরি!
বস শাহেদ আলীর ক্যানটিনে প্রবেশ। তিনি সিঙ্কে একটা প্লেট রাখতে গিয়েছিলেন। রক্তমাখা ছুরি দেখে তিনি আঁতকে উঠলেন।
তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ার পর তিনি অফিসে আবার এসেছেন; কারণ, একটু পরে নায়লা আসবে। নায়লা তার নতুন বান্ধবী। তাকে তিনি বলেছেন, ঠিক সাড়ে ছয়টায় আসবে। ছয়টার সময় শাহেদ অফিসে এলেন। অফিসে রাতের বেলা থাকে পিয়ন আক্কাস। তিনি অফিসের কাছে এসেই আক্কাসকে ফোন দিলেন:
‘আক্কাস, আছ অফিসে?’
‘জি স্যার।’
‘আমি আসতেছি। থাকো।’
‘জি আচ্ছা, স্যার।’
অফিসে গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন শাহেদ আলী। আক্কাস তখন লুঙ্গিপরা। প্যান্ট পরার চেষ্টা করছে। তার প্যান্টের জিপার বোধ হয় আটকে গেছে লুঙ্গির সঙ্গে।
শাহেদ আলী বললেন, ‘আক্কাস, একটা কাজ করো। যাও। পুরান ঢাকার ফুলমিয়ার দোকান থেকে দই আনো। ওখানে মোষের দই বিক্রি করে। দই কিনে সেটা আমার বাসায় দিয়া তারপর অফিসে আসবা। বুঝলা?’
‘জে স্যার।’
গেন্ডারিয়ায় ফুলমিয়ার দই ভান্ডার। সেখান থেকে যেতে হবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। কমসে কম তিন ঘণ্টার ধাক্কা। একটা পাঁচ শ টাকার নোট দিয়েছেন তিনি আক্কাসের হাতে। টাকা বাঁচাতে সে নিশ্চয়ই বাসে যাবে। অনেক সময় লাগবে। ততক্ষণে তিনি নায়লার সঙ্গে একবার নাগরদোলায়, একবার আকাশচারী বেলুনে, আরেকবার স্পিডবোটে রাইড সেরে নিতে পারবেন।
পিয়ন আক্কাস আলী বিদায় নিয়েছে।
অফিস ফাঁকা। পুরো মতিঝিলেই অন্ধকার নেমে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে নেমে এসেছে নির্জনতার আস্তর।
এই সময় অফিসে এমনিতেই ভয় ভয় লাগে।
এর মধ্যে তার ফাঁকা অফিসের সিঙ্কে রক্তমাখা ছুরি। কেন?
কে কাকে খুন করল? খুন করে ছুরিটা ধোয়ার জন্য সিঙ্ক পর্যন্ত আনল। খুনি ছুরিটা ধোয়ার সময় আর পায়নি।
‘কী করি মানে...তুমি ওই বদমায়েশ মহিলারে ক্যান রুমে ঢুকাইছ?’ দৌড়ে ছুরিটা নিয়ে আসেন নায়লা। ‘তোমার ছুরি আমি তোমার পেটে ঢুকাব...’
এখন তিনি কি ছুরিটা ধরবেন? ধরলেই তো তার হাতের আঙুলের ছাপ ছুরিতে লেগে যাবে। তিনি খুন করেননি। খুনের বিন্দুবিসর্গও জানেন না। কে খুন করেছে, তা যেমন তিনি জানেন না, তেমনি কে নিহত হয়েছে, তা–ও তার জানা নাই। এখন তিনি কী করবেন?
অফিসে তালা মেরে চলে যাবেন? পরে যদি দেখা যায়, অফিসে লাশ পচছে? দুর্গন্ধ বের হয়? লাশটা কোথায় থাকতে পারে? বাথরুমে? স্টোররুমে? আলমারির পেছনে?
তিনি দেখলেন, রক্তের ফোঁটা এসেছে ক্যানটিনের একটা টেবিল থেকে। নিচে রক্ত মোছার চেষ্টা। মেঝেতেও বেশ ক ফোঁটা রক্ত পড়ে আছে।
এই সময় অফিসে থাকা ঠিক হবে না। নায়লার আসার কথা। তাকে না করে দিতে হবে। সে এলে বরং ব্যাপারটা আরও ভয়ংকর হবে। পুলিশ দুজনকেই জেরা করবে। পত্রিকায় স্ক্যান্ডাল বেরোবে।
ক্যানটিনের ময়লার ঝুড়িতে চোখ গেল শাহেদ আলীর। ঝুড়িতে রক্তমাখা টিস্যু পেপার। কী সর্বনাশ!
তিনি তাড়াতাড়ি করে বের হলেন অফিস থেকে। অফিসে তালা লাগালেন।
তাঁর বুক কাঁপতে লাগল। অফিসে যদি লাশ পড়ে থাকে, তাহলে তিনিই ফাঁসবেন।
তিনিই সর্বশেষ অফিস রুমে ছিলেন। পিয়নকে দই কিনতে পুরান ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন! কী করা যায়!
তিনি আবার তালা খুললেন। অফিসের ম্যানেজারকে ডাকা যায়।
তিনি ফোন করলেন, ‘বাবুল সাহেব। আপনি কই?’
‘আমি স্যার একটু মতিঝিলেই। একটা প্যান্ট কিনেছিলাম ফুটপাত থেকে। দরজিকে দিয়ে সেটা অল্টার করাচ্ছি।’
‘আপনি কাইন্ডলি একটু অফিসে আসেন।’
‘ক্যানো স্যার?’
‘আরে, আসেন না! আমি আছি। দরকার আছে। ফোনে বলা যাবে না।’
এরই মধ্যে নায়লা এসে হাজির।
‘ডার্লিং...’
উফ্। তাড়াহুড়ায় আসল কাজটাই করা হয়নি। নায়লাকে নিষেধ করে দিতে হতো। কেন যে কাজের সময় আসল কথাটাই মনে থাকে না! ডার্লিংয়ের খ্যাতা পুড়ি।
‘নায়লা, তুমি কখন আসলা? শোনো, একটা কাজ করো। তুমি চলে যাও।’
‘ক্যানো?’
‘একটা সমস্যা হয়েছে?’
‘কী সমস্যা?’
‘আছে।’
‘বলো।’
‘না. থাক।’
‘ক্যানো না?’
‘তোমাকে বলা যাবে না।’
‘আমাকে বলা যাবে না! তোমার কী কথা থাকতে পারে, আমাকে বলা যাবে না!’
‘আছে। বাবা, বলব’—টেনশনে ঘেমে–নেয়ে বললেন শাহেদ আলী—‘পরে বলব। তুমি এখন একটু ফেভার করো। তুমি কাইন্ডলি যাও। আমাদের অফিস ম্যানেজার বাবুল আসতেছে। প্লিজ...।’
‘ক্যানো, সে কেন আসবে?’
‘জরুরি কাজে আমিই তাকে ডাকলাম।’
‘ডেকেছ ভালো করেছ। প্রিন্স থেকে বিরিয়ানি আনতে বলো। বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা করছে।’
‘আমি বাবুল সাহেবকে দিয়ে বিরিয়ানি আনাব?’
‘আচ্ছা, অনলাইনে অর্ডার দাও। এসে যাবে।’
‘মা নায়লা, দয়া করো মা। প্লিজ যাও।’
‘কী আবোল-তাবোল বলছ?’
‘হ্যাঁ। কারণ, একটা খুন হয়েছে। মার্ডার।’
‘কোথায়?’
বাবুল সাহেব এসে গেলেন। তার মাথায় টাক, গায়ের রং ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, হাতে শপিং ব্যাগে সম্ভবত নতুন কেনা প্যান্ট। তিনি বললেন, ‘স্যার, সর্বনাশ হয়েছে! আমাদের অফিসের সামনের ডাস্টবিনে একটা কাটা পা পাওয়া গেছে!’
‘কী বলেন?’
‘জি স্যার। আজকালকার খুনিরা তো খুব নিষ্ঠুর হয়। লাশ কয়েক টুকরা করে জায়গায় জায়গায় ছড়ায়া দেয়। আমাদেরকে দিয়েছে পা।’
‘শুধু পা না বাবুল সাহেব। ছুরিটাও দিয়ে গেছে।’
‘স্যার!’
‘খুনি খুন করে সেই ছুরিটা আমাদের অফিসের সিঙ্কে রেখে গেছে।’
‘কী বলেন স্যার!’
‘আসেন। দেখেন।’
আগে চললেন শাহেদ আলী। পেছন পেছন চললেন নায়লা আর বাবুল। বাবুল সাহেব নায়লাকে চেনেন। সিসিটিভিতে তাকে ঢুকতে দেখা যায়। বসের রুমে ঢোকে। সন্ধ্যার পর। এই সব নিয়ে কথা বলতে হয় না। বাবুল বলেনও না।
ছুরি দেখে বাবুল টের পেলেন এটা কিসের ছুরি। এই রক্ত কিসের।
ড্রাগন ফলের।
ড্রাগন ফলের ভেতরটা এত লাল! কাটলে পরে যে রস বের হয়, তা একেবারে রক্তের মতো টকটকে।
শ্রাবণী ড্রাগন ফল অফিসে এনেছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর ডোমারে। সেখানে ড্রাগন ফলের চাষ হয়। সেখান থেকে তার জন্য পারসেল আসে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসে। তিনি নিজে খান, বন্ধুদের দেন।
অফিসে বসে ছুরি দিয়ে ড্রাগন ফল কেটে খেয়ে তিনি ছুরিটা অফিসের ক্যানটিনের সিঙ্কে রেখে দিয়েছেন।
বাবুল সাহেব নিজের চোখে দেখেছেন। তখনই বাবুল সাহেবেরও মনে হয়েছিল, ড্রাগন ফলের রসের রং একেবারে রক্তের মতো।
‘বুঝতে পারলেন কিছু?’ শাহেদ আলী বললেন।
‘স্যার।’
‘খুনি খুন করে তার ছুরিটা আমাদের অফিসে রেখে গেছে!’
‘স্যার।’
‘এখন কী করা যায় বাবুল সাহেব?’
‘আপনি বলেন স্যার।’
বাবুল সাহেবের টেবিলের পেছনের দেয়ালে একটা নোটিশ টাঙানো আছে।
রুল নম্বর ওয়ান: দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট।
রুল নম্বর টু: ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।
কাজেই বস যা বলবেন, তাতেই সম্মতি জানাতে হবে বাবুল সাহেবকে।
‘একটা কাজ করি। মতিঝিল থানায় ফোন করি। থানার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার রাজু আমার বন্ধু। তাকে ডেকে আনি।’ বললেন শাহেদ আলী।
‘জি স্যার। স্যার, এই ফাঁকে আমরা সিসিটিভির ফুটেজ চেক করি। কে কীভাবে খুন করে ছুরিটা এনে রাখল, ধরা পড়ে যাবে, স্যার।’
‘ঠিক। কারেক্ট। আসেন। সিসিটিভি দেখেন।’
বাবুল তার কম্পিউটারে বসে সিসিটিভির ফুটেজ চালালেন। নায়লা আর বস দেখছেন।
মনিটরে ভেসে উঠছে:
বেলা তিনটা।
একটা মডেল এসে ঢুকল বসের রুমে। এই মডেলের নাম রুম্পা।
নায়লা বললেন, ‘এই তোমার রুমে এইটা কে ঢোকে?’
‘আরে বোলো না। কতজনই তো আসে!’
নায়লা বললেন, ‘এটা তো রুম্পা।’
‘রুম্পা নাকি? আমি নাম জানি না। কী একটা কাজে এসেছিল।’
‘কী একটা কাজে। কই হারামজাদি বের হচ্ছে না তো। ব্যাপার কী?’
‘ব্যাপার কী মানে। আমার কাছে কতজন আসে!’
‘কতজন আসবে কেন? তাহলে তুমি আমাকে ডাকো কেন? রুম্পা হারামজাদি তোমার রুমে, ফরোয়ার্ড করেন তো বাবুল ভাই...আরে এ তো পুরো ৪৮ মিনিট ছিল...৪৮ মিনিটে একটা ...ফাজলামো পাইছ’...হাতের কাছের ফাইল নিয়ে মেরে বসেন নায়লা...
‘আরে কী করে...’
‘কী করি মানে...তুমি ওই বদমায়েশ মহিলারে ক্যান রুমে ঢুকাইছ?’
দৌড়ে ছুরিটা নিয়ে আসেন নায়লা। ‘তোমার ছুরি আমি তোমার পেটে ঢুকাব...’
শাহেদ আলী ছুরি কেড়ে নিতে যান। নিজের হাত কেটে যায়...রক্তে ছুরি আরও লাল হয়। কার্পেটে রক্ত পড়ে।
এই সময় পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের প্রবেশ।
‘কী সমস্যা শাহেদ। কল দিছ কেন?’
‘দোস্ত। আমার অফিসের সামনে কাটা পা। অফিসের মধ্যে রক্তমাখা ছুরি। কী সমস্যায় না আমি পড়ছি।’
রাজু ওয়াকিটকিতে কথা বলতে লাগলেন। আরও পুলিশ আসে। পুরা অফিস সার্চ করা হয়। দুইটা ব্ল্যাক লেভেলের বোতল পাওয়া যায়।
পুলিশ বুরো অব ইনভেস্টিগেশনের লোকজন এসে পড়লেন।
তারা বললেন, ‘আপনাদের তিনজনকেই একটু থানায় আসতে হবে।’
বাবুল তাড়াতাড়ি করে সেই সিসিটিভি ফুটেজ বের করলেন।
মনিটরে দেখা যাচ্ছে:
শ্রাবণী আহমেদ ড্রাগন ফল কাটলেন। তাতে ছুরিটা লাল হয়ে গেল। তিন ফোঁটা রস পড়ল মেঝেতে। তিনি টিস্যু দিয়ে মেঝে মুছলেন। তারপর টিস্যু ফেললেন ময়লার ঝুড়িতে।
পুলিশও সব দেখছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর লোকজনও দেখলেন।
তারা ময়লার ঝুড়ি চেক করলেন। ভেতরে ড্রাগন ফলের খোসাও পাওয়া গেল।
রাজু আহমেদ হাসছেন। বললেন, ‘যাও দোস্ত, বাসায় যাও।’
ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর লোকজন বললেন, ‘আপনারা কেউ ঢাকা ছাড়তে পারবেন না। আমাদের ইনভেস্টিগেশন যতক্ষণ শেষ না হয়।’
নায়লা আর শাহেদ আলী বেরোচ্ছেন, সাপ্তাহিক ভয়ংকর অপরাধ পত্রিকার সাংবাদিক দুজনের ছবি তুলে ফেলল।
দুদিন পরে সামনের ডাস্টবিনের কাটা পায়ের উৎস পাওয়া গেল।
পাশেই একটা ক্লিনিক আছে। ওরা অপারেশন করে একজন ক্যানসার রোগীর পা কেটে ফেলেছে। সেটাই ডাস্টবিনে চলে এসেছে।