শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা এই মামলায় আপিল করার শর্তে জামিন পেয়েছেন ড. ইউনূসসহ চারজন।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা গতকাল সোমবার বিকেলে এ রায় দেন। সাজাপ্রাপ্ত অপর তিনজন হলেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। রায় ঘোষণার সময় ড. ইউনূসসহ চারজনই আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায় ঘোষণার পর উচ্চ আদালতে আপিল করার শর্তে ড. ইউনূসসহ চারজনকেই এক মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন একই আদালত। জামিন পাওয়ার পর আদালত থেকে বেরিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে দোষ করিনি, সেই দোষে শাস্তি পেলাম। এই দুঃখটা মনে রয়ে গেল।’
নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদের বিরুদ্ধে করা মামলাটির রায় ঘোষণা উপলক্ষে বিজয় নগরের টাপা প্লাজায় স্থাপিত তৃতীয় শ্রম আদালতের সামনে গতকাল বেলা ১১টা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য অবস্থান নেন। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মী, পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকারকর্মীরা।
বেলা পৌনে দুইটার দিকে আদালতকক্ষে প্রবেশ করেন ৮৩ বছর বয়সী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সোয়া দুইটার দিকে এজলাসে বসেন বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা। রায় ঘোষণার শুরুতেই বিচারক আসামিপক্ষের আগে করা পৃথক দুটি আবেদন নামঞ্জুর করেন। পরে তিনি জানান, ‘রায়টি বড় হবে। এ ফোর সাইজে ৮৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়। পুরো রায় পড়ছি না।’
বিচারক রায়ের উল্লেখযোগ্য অংশ পড়ে শোনান। তিনি একপর্যায়ে বলেন, ‘এখানে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের বিচার হচ্ছে না। ড. ইউনূস, যিনি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, তাঁর বিচার হচ্ছে।’
বিচারক মামলাটির বিস্তারিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি কলকারখানা অধিদপ্তরের পরিদর্শক গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে গিয়ে শ্রম আইনের লঙ্ঘন দেখতে পান। পরে তা সংশোধনের জন্য বিবাদীপক্ষকে ওই বছরের ১ মার্চ চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন সংশোধনের পর গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষ থেকে এর জবাবে ৯ মার্চ যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, তা সন্তোষজনক ছিল না।
২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর শ্রম ট্রাইব্যুনালে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। গত বছরের ৬ জুন মামলার অভিযোগ গঠিত হয়। ২২ আগস্ট সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়, যা শেষ হয় ৯ নভেম্বর। গত ২৪ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হলেও তাঁদের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া হয়নি। গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি এবং লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি।
রায়ের ভাষ্য অনুযায়ী, ড. ইউনূসসহ অন্যরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে লিখিত বক্তব্য জমা দেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী যুক্তিতর্ক শুনানিতে বলেছিলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ মামলা হয়নি। তবে বাদীপক্ষের সাক্ষ্য এবং তাঁদের উপস্থাপিত দলিল থেকে প্রমাণিত হয়েছে, শ্রম আইন অনুযায়ী যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের একজন পরিদর্শক মামলা করেছিলেন।
আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখিতভাবে বলেছিলেন, গ্রামীণ টেলিকমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী। কারণ, গ্রামীণ টেলিকম যেসব ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে, সেগুলো চুক্তিভিত্তিক। তবে গ্রামীণ টেলিকমের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্থায়ী কর্মীর মতো ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড), আনুতোষিক (গ্র্যাচুইটি), অর্জিত ছুটি ও অবসরকালীন ছুটি দেওয়া হয়ে থাকে।
গ্রামীণ টেলিকমের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিজস্ব নীতিমালা আছে, যা অনুমোদনের জন্য ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক বরাবর পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আবেদন বিষয়ে গ্রামীণ টেলিকমকে কোনো কিছু অবহিত করা হয়নি। এরপর ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট পুনরায় গ্রামীণ টেলিকম নিয়োগের নীতিমালাসহ সংশ্লিষ্ট নীতিমালা অনুমোদনের জন্য মহাপরিদর্শক বরাবর পাঠানো হয়। কিন্তু এ বিষয়ে যথাযথ আদেশ দেওয়া হয়নি।
রায়ে আদালত বলেন, গ্রামীণ টেলিকম নিয়োগের নীতিমালা অনুমোদনে যথাযথ আদেশ না দেওয়ার বিষয়ে আসামিপক্ষ আদালতে আসতে পারতেন। আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে গ্রামীণ টেলিকম নিয়োগের নীতিমালা অনুমোদন না হলেও নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগসহ অন্যান্য কার্য সম্পন্ন করেছে; যা শ্রম আইনের লঙ্ঘন।
রায়ে আদালত বলেছেন, মামলায় ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইনের তিনটি ধারা এবং শ্রম বিধিমালার একটি ধারার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আদালত শ্রম আইনের ৩০৩ (ঙ) ও ৩০৭ ধারা অনুযায়ী আসামিদের ছয় মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৩০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন। একই সঙ্গে ৩০ দিনের মধ্যে শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণসহ লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
রায় ঘোষণার পর বাইরে এসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, এই রায় নজিরবিহীন। রায়ের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।
আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শ্রম আইনে বলা হয়েছে, শ্রমিকের বার্ষিক মজুরি না দেওয়া হলে, পরে তাঁর মূল মজুরির সঙ্গে যোগ হবে। এটা কোনো অপরাধ নয়। শ্রমিকদের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ যদি না দেওয়া হয়, তাহলে শ্রম আইন অনুযায়ী, টাকা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করে দেবে কর্তৃপক্ষ। সময় নির্ধারণের পর জরিমানা করা হবে। এরপরও অনেকগুলো ধাপ রয়েছে। কিন্তু এসব ধাপ বা পদ্ধতি গ্রহণ না করে দেওয়ানি বিষয়ে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনে ড. ইউনূসসহ চারজন আদালতকে লিখিতভাবে বলেছিলেন, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনে নিবন্ধিত, আইনটির ২৮ ধারায় সৃষ্ট একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় হয়, তা বিতরণযোগ্য নয়।
তবে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলাটি বাদীপক্ষ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, গ্রামীণ টেলিকম শ্রম আইন না মেনে নিজস্ব আইন মেনেছে। এ জন্য দুবার তাদের কারণ দর্শানো হয়েছিল। কিন্তু তারা কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। তাদের যে ত্রুটিগুলো ছিল, সেটি তারা সংশোধন করেনি।
রায় ঘোষণার সময় আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান, মানবাধিকারকর্মী ফরিদা আখতার, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, শারমিন মুর্শিদ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আইনজীবী সারা হোসেন প্রমুখ।
ড. ইউনূসের সাজার রায়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন আইরিন খান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ দেশে বহু শ্রম আইন লঙ্ঘনকারী রয়েছে। কীভাবে শ্রমিকেরা ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য লড়াই করছেন। শ্রমিকনেতাকে গুলি করে মারা হচ্ছে। অথচ আইনকে অস্ত্র বানিয়ে ড. ইউনূসের মতো একজন নোবেলজয়ীকে সাজা দেওয়া হলো। এটা পলিটিসাইজেশন অব জাস্টিস সিস্টেম।’