সারা দেশেই বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে শিশুরা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের ডেঙ্গু চিকিৎসা তুলনামূলক কঠিন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২১ শতাংশ রোগীই শিশু। এদের বয়স ১৫ বছর বা তার কম। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে শিশুদের ঢাকায় আনা হচ্ছে, এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
ডেঙ্গুতে ইতিমধ্যে মারা যাওয়া ২২৫ জনের মধ্যে ৩৬ জনই শিশু। ডেঙ্গু মৌসুম শেষ হওয়ার আগে শিশুদের মৃত্যু আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গু পরিস্থিতির সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার তথ্যে বলা হয়েছে, নতুন ২ হাজার ৩৬১ জন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। আর মারা গেছেন ১০ জন। এ নিয়ে ডেঙ্গুতে এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা হলো ২২৫।
গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৪২ হাজার ৭০২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৯ হাজার ১২৪ জন। অর্থাৎ মোট রোগীর ২১ শতাংশই শিশু।
গতকাল সকালে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের (ঢাকা শিশু হাসপাতাল) নিচতলার দুই নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডে কোনো শয্যা খালি নেই। প্রতিটি শয্যায় একজন করে শিশু এবং সঙ্গে তার বাবা অথবা মাকে দেখা গেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই ওয়ার্ডটি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য নির্ধারণ করেছে। এতে শয্যা ৪২টি। ওয়ার্ডের ৫ নম্বর শয্যার শিশুটির নাম ছিল উৎপল সরকার। বয়স ১৪ মাস। সঙ্গে ছিলেন শিশুটির মা রত্না সরকার। তারা রাজধানীর ইন্দিরা রোডের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। স্বামী মুদিদোকানি। তাঁর আয়েই সংসার চলে।
রত্না সরকার জানালেন, ২০ জুলাই ছেলেকে এই হাসপাতালে ভর্তি করান। দু–এক দিনের মধ্যে ছেলেকে ছুটি দেবে বলে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে। তবে ইতিমধ্যে তাঁদের ২৩ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। খরচ চালাতে তাঁদের কষ্ট হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একটি বিনা মূল্যের শয্যা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
একটু দূরে ১২ নম্বর শয্যায় চিকিৎসা নিচ্ছে সাড়ে চার বছরের শিশু সাজিদ। সঙ্গে ছিল তার বাবা মোহাম্মদ সজীব। তাঁরা এসেছেন কেরানীগঞ্জের আটিপাড়া থেকে।
ডেঙ্গু রোগীদের রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করতে হয়। অনেকে শিশুদের রক্তচাপ পরিমাপে অভ্যস্ত নয়।ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা
মোহাম্মদ সজীব প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল। ২৩ জুলাই হাসপাতালের বহির্বিভাগে ছেলেকে দেখান এবং পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। ওই দিনই ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ইতিমধ্যে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে রোগীর চাপ বেশি। ভর্তির সময় অনেক দেনদরবার করতে হয়। একবার ভর্তি হতে পারলে আর সমস্যা নেই। এখানে চিকিৎসা ভালো, সব সময় চিকিৎসক ও নার্স থাকেন।’
এদিকে হাসপাতালের পরিচালকের কার্যালয় জানিয়েছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি ওয়ার্ডে ৪২টি শয্যা বরাদ্দ। গতকাল হাসপতালে ভর্তি ছিল ৯৮টি শিশু। অর্থাৎ বরাদ্দ করা শয্যার দ্বিগুণের বেশি শিশু ওই হাসপাতালে ভর্তি ছিল। বাড়তি শিশুদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে অন্য রোগের শিশুদের সঙ্গে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
১ জানুয়ারি থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিল ডেঙ্গু আক্রান্ত ৩৯৯ জন শিশু। সব শিশুদের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ছেলেশিশুর চেয়ে মেয়েশিশু হাসপাতালে বেশি আসছে। চিকিৎসা নেওয়া শিশুদের ৬৩ শতাংশ মেয়ে আর ৩৭ শতাংশ ছেলে। এদের মধ্যে মারা গেছে আটটি শিশু।
দিন যত যাচ্ছে, হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা তত বাড়ছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ভর্তি হয় ১০ জন, এপ্রিলে ভর্তি হয় ১১ জন, মে মাসে ১৫ জন ভর্তি হয়। আর জুন মাসে ভর্তি হয় ৬৩ জন। আর চলতি জুলাই মাসে (২৬ জুলাই) ভর্তি হয়েছে ৩০০ জন।
শিশুদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ বছর বয়সীদের হার বেশি দেখা যাচ্ছে। ৩৫ শতাংশ শিশুর এই বয়সসীমায়। ৩২ শতাংশ শিশুর বয়স ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে। এক বছরে কম বয়সী শিশু ১৩ শতাংশ আর ২০ শতাংশ শিশুর বয়স ১০ বছরের ওপরে।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, চিকিৎসা নেওয়া ২২৫ জন শিশু এসেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে, ৯৩ জন এসেছিল দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে এবং ৮২ জন এসেছিল ঢাকার কয়েকটি উপজেলা ও দেশের ২৬টি জেলা থেকে। লক্ষ্মীপুর জেলা থেকে সবচেয়ে বেশি ৮টি শিশু এসেছে।
এখানে রোগীর চাপ বেশি। ভর্তির সময় অনেক দেনদরবার করতে হয়। একবার ভর্তি হতে পারলে আর সমস্যা নেই। এখানে চিকিৎসা ভালো, সব সময় চিকিৎসক ও নার্স থাকেনঅভিভাবক মোহাম্মদ সজীব
শুধু বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে যে চিকিৎসার জন্য ডেঙ্গু রোগী বেশি আসছে তা নয়। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও এক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে, এক শয্যায় দুটি শিশু রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, দিন দিন হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশু বাড়ছে।
গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৪২ হাজার ৭০২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৯ হাজার ১২৪ জন। অর্থাৎ মোট রোগীর ২১ শতাংশই শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, শিশুর সময়সীমা ১৮ বছর ধরলে ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট শিশুর সংখ্যা ও হার আরও বাড়বে। ১৮ বছরের বয়সসীমার বিভাজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে নেই।
যে ৩৬ জন শিশু মারা গেছে, তাদের মধ্যে ছেলে ও মেয়েশিশুর সংখ্যা সমান।
ডেঙ্গু আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের চিকিৎসার চেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কঠিন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করতে হয়। অনেকে শিশুদের রক্তচাপ পরিমাপে অভ্যস্ত নয়।
এটা একটি ঝুঁকি। অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগীর শরীরের তরল পদার্থ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে তরল কম বা বেশি হলেই তুলনামূলকভাবে জটিলতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের উচিত ডেঙ্গু চিকিৎসার নির্দেশিকা মেনে চলা।