মূল্যস্ফীতি
মূল্যস্ফীতি

বিশ্লেষণ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ কম

জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে সাধারণ মানুষও কেন রাস্তায় নেমেছিল? বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এর পেছনে অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতিও অন্যতম কারণ। তিনি এ কথা বলেছিলেন গত ১৪ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে।

সারা বিশ্বেই রাজনীতিকে সবচেয়ে প্রভাবিত করে অর্থনীতির যে সূচক, তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, একটি সরকারকে সবচেয়ে বেশি অজনপ্রিয় করে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিভাগের অধ্যাপক হ্যারল্ড জেমস ২০২৩ সালে লিখেছিলেন, গণতন্ত্রে নির্বাচনের ফলাফল প্রায়ই বাজারদরের ওপর নির্ভর করে। তবে স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদী সরকারও যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিপদে পড়ে, এমন উদাহরণও আছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় অর্থনীতির নীরব ঘাতক। আর এই ঘাতক কতটা নির্মম হতে পারে, তা দেশের মানুষ দেখেছে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে। তাতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই দেশে মূল্যস্ফীতি কমেনি। অথচ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়।

এটা ঠিক যে অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকারসূত্রেই এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি হাতে পেয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত আগস্ট মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়েছে। যদিও সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতি কমার কোনো প্রভাব জীবনযাত্রায় খুঁজে পাচ্ছে না। বরং প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। অথচ নতুন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার অন্তত মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে তারা মুক্তি পাবে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ৯ অক্টোবর সচিবালয়ে বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি। একটু সময় লাগবে।’ এ জন্য তিনি অধৈর্য না হতে বলেছেন। তবে বাজারের যে পরিস্থিতি, তাতে মানুষের পক্ষে ধৈর্য ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে।

অগ্রাধিকার হোক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

সরকারের সামনে এখন অনেক এজেন্ডা। শিক্ষার্থী হত্যার বিচার; পাচার করা অর্থ ফেরত আনা; পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচনব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কার; ব্যাংক খাতের অব্যবস্থাপনা দূর করা, শ্বেতপত্র প্রণয়ন, ইত্যাদি। তবে মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে মূলত দুটি বিষয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বাজারদর। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে এই দুই দিকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দিতে হবে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ৯ অক্টোবর সচিবালয়ে বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি। একটু সময় লাগবে।’ এ জন্য তিনি অধৈর্য না হতে বলেছেন। তবে বাজারের যে পরিস্থিতি, তাতে মানুষের পক্ষে ধৈর্য ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারের গৃহীত নীতির প্রতি মানুষের আস্থা থাকতে হবে। সরকার যে আসলেই মূল্যম্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে, এই বিশ্বাসটা আনতে হবে। এমন নয় যে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিভিন্ন পণ্যের শুল্কহার কমানো হয়েছে। নীতি সুদহার বেড়েছে। তবে এখনো এর তেমন কোনো প্রভাব বাজারে দেখা যাচ্ছে না।

নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের উচিত দ্রুততার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশার জরিপটি চালু করা।

যেসব দৃশ্যমান পদক্ষেপ প্রয়োজন

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এখন আর একটি-দুটি বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপে কাজ হবে না। পুরো বিষয়টি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।

১. মানুষের মনোভাব জানুন: যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নীতিনির্ধারকদের বাজারের প্রকৃত অবস্থা জানতে হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এ জন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশ ‘ইনফ্লেশন এক্সপেক্টেশন’ নামে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে সামনের দিনগুলোতে বাজারে দাম বাড়বে কি না, এ নিয়ে ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মনোভাব বা ভাবনা জানতে চাওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের এই প্রত্যাশা বা মনোভাবের ওপরই নির্ভর করে মূল্যস্ফীতির গতি-প্রকৃতি। যদি ব্যবসায়ীরা মনে করেন মূল্যস্ফীতি ৩ শতাংশ বাড়বে, তাহলে তাঁরাও পণ্যের দাম ৩ শতাংশ বাড়ানোর ব্যবস্থা করবেন। শ্রমিকেরাও তখন ৩ শতাংশ বেতন বাড়ানোর দাবি তোলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মূল্যস্ফীতি ঠিকই ৩ শতাংশ বেড়ে যায়।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক একসময় ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে এই জরিপ পরিচালনা করত। এমনকি ২০১৮ সালের মুদ্রানীতিতে ‘ইনফ্লেশন এক্সপেক্টেশন’ জরিপ অন্তর্ভুক্তও করা হয়েছিল। পরে মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশার হার অনেক বেশি আসায় জরিপের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগের উচিত দ্রুততার সঙ্গে মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশার জরিপটি চালু করা।

২. পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখুন: বাংলাদেশ বেশির ভাগ খাদ্যপণ্য বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করে। গত জুলাই ও আগস্ট মাসে গমের আমদানি কমেছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ, সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমেছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, এর মধ্যে চিনির আমদানিই কমেছে সাড়ে ৫২ শতাংশ। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় সব পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখাই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের জন্য সতর্কসংকেত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে সংকট বাড়ায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ছে। সুতরাং একই সঙ্গে সরকারকে আমদানির ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও করতে হবে।

৩. বাজার তদারকি বাড়ান: সরবরাহ ঠিকঠাক রাখার পাশাপাশি প্রয়োজন বাজার তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজি আছে। উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে কয়েক দফা হাতবদল হয়। সরকার পরিবর্তন হলেও চাঁদাবাজি ও হাতবদলের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। মানুষ বদল হয়েছে কেবল। এ ব্যাপারে সরকার কোনো শক্ত অবস্থানে যেতে পারেনি। প্রশাসনিক দুর্বলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এর বড় কারণ।

৪. আইনশৃঙ্খলা ঠিক করুন: নতুন সরকার আসার পর দৃশ্যমান পদক্ষেপ সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ব্যাংক খাতে। এতে ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থা বেড়েছে, আমানতও বেড়েছে। কিন্তু সেই আস্থা এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর আসেনি। ফলে কোনো অনিয়ম বা চাঁদাবাজির জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এই ভয় অনেকটাই কম। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বিনিয়োগকারীরাও আস্থা পাবে না। এতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমবে এবং হ্রাস পাবে কর্মসংস্থান।

৫. চোরাচালান ঠেকান: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ভারতে লোক চলাচল কমে গেছে। ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি এর প্রধান কারণ। তবে পণ্য চলাচল, বিশেষ করে চোরাচালান বন্ধ হয়নি। চিনি এর বড় উদাহরণ। উচ্চ শুল্কহারের কারণে চিনি আমদানি কমেছে। অন্যদিকে ভারত থেকে চোরাই পথে আসছে চিনি। এ অবস্থায় সরকার চিনির শুল্কহার কমিয়েছে। তবে এর প্রভাব এখনো বাজারে পড়েনি। এদিকেও তদারকি প্রয়োজন।

৬. দূর করতে হবে অনিশ্চয়তা: অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু অনিশ্চয়তা। অনিশ্চয়তা থাকলে মানুষের আস্থাও ফিরবে না, ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করবেন না। সরকার যেসব নীতি গ্রহণ করছে, তার ধারাবাহিকতা নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা আছে। অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন থাকবে, সে সম্বন্ধে ধারণা পেলে অনিশ্চয়তা কিছু কমবে। সংস্কারের রোডম্যাপ উদ্যোক্তাদেরও জানা দরকার। তাতে বিনিয়োগ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁদের জন্য সহজ হবে।

৭. ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করুন: বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তাঁদের কেউ কেউ নানা অনিয়ম করেছেন, নামে-বেনামে ব্যাংকঋণ নিয়ে ফেরত দেননি, আত্মসাৎ করা অর্থের বড় অংশ পাচারও করেছেন। এই সব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াকে সবাই সমর্থন করছে। তবে এই প্রক্রিয়া যত দ্রুত হবে, ততই অর্থনীতির জন্য ভালো। তাতে অন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করা, নির্বিঘ্নে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করার সুযোগ তৈরি করা।

৮. উদ্যোক্তাদের কথা শুনুন: অন্তর্বর্তী সরকারে বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিনিধি নেই। পুরো সরকার কাঠামোতেই বেসরকারি খাতের অনুপস্থিতি দৃশ্যমান। তাদের সঙ্গে সরকারের সরাসরি যোগাযোগ যেমন নেই। অনেকটাই গুরুত্বহীন অবস্থায়ও আছেন তাঁরা। অর্থনীতির জন্য এ চিত্র ক্ষতিকর। সুতরাং ব্যবসায়ীদের কথা শোনার একটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এ জন্য বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করতে পারেন। এতে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের নিয়মিত আলোচনার একটি পথও তৈরি হবে।

৯. ভালো ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনুন: যেসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অনিয়ম নিয়ে সরকার তদন্ত করছে, তাদের মধ্যে বড় বড় ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীও রয়েছে। যেমন এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা প্রভৃতি। তাদের সবার আমদানি কমে গেছে। এর ফলে বাজারে চাহিদা-সরবরাহের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য দেখা দিচ্ছে। সরবরাহে ঘাটতি হলে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, এই ঘাটতি পূরণ করার মতো বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দেশে আছেন। সুতরাং মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ বা টি কে গ্রুপের মতো আরও যারা আছে, তাদের আস্থায় এনে সরবরাহব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এ রকম আরও অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা এত দিন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের জন্য ভোগ্যপণ্যের বাজারে ঢুকতে পারেননি, তাঁদেরও এই সুযোগ দিতে হবে। এতে বাজার সিন্ডিকেট বন্ধ হবে। এ জন্য ব্যাংক খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। ডলারের বাজারও স্থিতিশীল রাখতে হবে।

১০. ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা প্রয়োজন: অর্থনীতির গতি এখনো যথেষ্ট শ্লথ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমবে। এ অবস্থায় সরকারকে অবশ্যই অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে। সরকারি আয় ও ব্যয় পরিস্থিতি, কোথায় কৃচ্ছ্রসাধন করা হবে, তারও পরিষ্কার ঘোষণা থাকা দরকার। অর্থবছরের তিন মাস চলে গেছে। এ অবস্থায় সরকার বাজেট ও অর্থনীতির একটি ত্রৈমাসিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে করণীয় বিষয়ে জানাতে পারে। তাতে সরকারের অর্থনৈতিক নীতিও পরিষ্কার হবে সবার কাছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে ১৯৭৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডাল। তখন তিনি সরকারের গৃহীত নীতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে মানুষের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস আছে। অথচ দরকার সরকারের শক্ত বা ধারালো পদক্ষেপ।’বাংলাদেশের মানুষও এখন এমনটাই চায়।