৭ মাসের সন্তান পেটে নিয়ে ১৪ দিন জেল খেটেছিলেন নুসরাত সোনিয়া। পটুয়াখালীর এই স্কুলশিক্ষকের ‘অপরাধ’ ছিল, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া। ৫৭ ধারায় মামলার আসামি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকরিটাও খুইয়েছেন তিনি। মানসিক ও সামাজিক হয়রানির পাশাপাশি মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন এই নারী।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইনগুলোর প্রায় একই ধারায় ঘুরেফিরে হাজার হাজার মানুষের নামে মামলা হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। সমালোচিত এই আইনটি বাতিলের দাবি উঠেছে। পাশাপাশি এসব আইন দ্বারা নুসরাতের মতো যাঁরা হয়রানির শিকার হয়েছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচারের দাবিও উঠেছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাতিলযোগ্য সাইবার নিরাপত্তা আইন: জনগণের প্রত্যাশা’ শিরোনামে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এ বিষয় উঠে আসে। ডিজিটালি রাইট, নাগরিক এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারীর অফিস এ বৈঠকের আয়োজন করে।
বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে মানবাধিকারকর্মী অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, আগের সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। সামনে যে আইন আসবে, সেটা যেন আর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ না পায়। আইন বাতিলসহ মামলাগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিসহ এ আইনের অপব্যবহারের সঙ্গে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সবাইকে জবাবদিহি ও বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠে আসে এ গোলটেবিলে। এ বিষয়ে অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, বিচারপ্রক্রিয়ায় যাঁরা যুক্ত ছিলেন, যাঁরা রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করেছেন, তাঁদেরও জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। হেফাজতে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার যাঁরা, সেসব ঘটনারও তদন্ত করতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারে প্রত্যক্ষভাবে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা ছাড়াও আদালত থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যারা অপব্যবহারে সঙ্গে জড়িত, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, আইনটি বাতিল ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
গোলটেবিল বৈঠকে অন্তত ১৫ জন ভুক্তভোগী নিজেদের হয়রানি–নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, শিক্ষার্থী, সংখ্যালঘু, চলচ্চিত্রকর্মী, ভুক্তভোগীর সন্তান নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া হয়রানি, অন্যায় ও নিপীড়নের বর্ণনা দেন।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক আবু তৈয়ব মুন্সী এবং আবদুল লতিফ জানান, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের বিপক্ষে তাঁদের সংবাদ প্রচার ও ফেসবুক পোস্ট দেওয়ায় তাঁদের জেলে যেতে হয়েছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। গ্রেপ্তারপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলার এখনো কোনো অভিযোগপত্র হয়নি। ছয় বছর ধরে হাজিরা দিচ্ছেন।
সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় বেশ কিছু সুপারিশ করার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের কর্মকর্তা লিভিয়া কসোনজা বলেন, বর্তমান সরকার আইনটি বাতিলের কথা বলছে। আইন বাতিল হলে মামলাও প্রত্যাহার করতে হবে।
আর্টিকেল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম বলেন, ডিজিটাল বা সাইবার নিরাপত্তার দুটি আইনের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল হয়রানি করা। এ ধরনের উদ্দেশ্য মাথায় রেখে যেন আর কোনো আইন না হয়।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, সাইবার অবকাঠামোগত নিরাপত্তা এবং কনটেন্ট গভর্ন্যান্স দুটি দিক থেকেই আইনটি বাতিলের যোগ্য। আইনটি ডেটা সুরক্ষা ও সাইবার অবকাঠামোর দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের দায়িত্ব ও শাস্তির কথা বলে না। অনলাইন সেফটি আইন অনেক কঠিন বিষয়। এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয় যুক্ত। এসব আইন করতে হলে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সাইবার নিরাপত্তা আইন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ২৭৫টি মামলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। আইনটির অপব্যবহার থেমে নেই। মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
গোলটেবিল বৈঠকে ধারণাপত্র তুলে ধরেন মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান। আরও বক্তব্য দেন রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোস্তফা হোসেইন ও শরৎ চৌধুরী, ইন্টার নিউজের শারমীন শিউলি, ভুক্তভোগী দিদারুল ভূঁইয়া, খাদিজাতুল কোবরা, দিলীপ রায় প্রমুখ।