বাল্যবিবাহ নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন রুচিরা তাবাস্সুম নভেদ্।
গবেষণায় বলা হয়, ‘টিপিং পয়েন্ট’ উদ্যোগটি বাল্যবিবাহ রোধে আশাব্যঞ্জক ফল দেখিয়েছে।
বাংলাদেশে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রতি দুটি মেয়ের একটির বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাল্যবিবাহের এই উচ্চ হারের অন্যতম কারণ সামাজিক প্রবণতা। এর ফলে পরিবারগুলো অন্যের সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হয়। বেশির ভাগ মানুষ কী করছে, সেই সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হওয়ায় বাল্যবিবাহ সহজে কমছে না। তবে কিশোর-কিশোরী, তাদের অভিভাবক ও স্থানীয় জনগণকে নিয়ে সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিলে বাল্যবিবাহ অর্ধেকের বেশি কমে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত চার দিনব্যাপী উন্নয়ন সম্মেলনের শেষ দিন গতকাল মঙ্গলবার এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়। গবেষণাটি করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। সম্মেলনে ‘ইফেকটিভনেস অব টিপিং পয়েন্ট: আ গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল নর্ম ইন্টারভেনশন ইন রিডিউসিং চাইল্ড ম্যারেজ’ (‘টিপিং পয়েন্ট’–এর কার্যকারিতা: বাল্যবিবাহ রোধে কিশোরী ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক প্রবণতা পরিবর্তনের একটি উদ্যোগ) শিরোনামের গবেষণায় দেখানো হয়েছে, নির্দিষ্ট সময় ধরে সচেতনতামূলক পদক্ষেপে ৫৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ কমানো সম্ভব হয়েছে। সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ‘টিপিং পয়েন্ট’ হলো বড় পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ।
কিশোরী ও বাবা-মায়েদের অন্তর্ভুক্ত করায় তাঁদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছিল এবং বাল্যবিবাহের ঝুঁকি কমার হার বেড়েছিল।
সম্মেলনে বাল্যবিবাহ নিয়ে এ পর্বে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া আইসিডিডিআরবির মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের ইমেরিটাস বিজ্ঞানী রুচিরা তাবাস্সুম নভেদ্।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিবাহের উচ্চ হারের দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। দেশে বাল্যবিবাহের সামাজিক প্রবণতাকে শনাক্ত করা ও মেয়েদের ক্ষমতায়নে টিপিং পয়েন্টের প্রভাব দেখা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থা কেয়ার কিশোরীদের ক্ষমতায়ন ও বাল্যবিবাহমুখী সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে টিপিং পয়েন্ট নামে কার্যক্রম তৈরি করে।
কার্যক্রমে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ৫১টি গ্রামের কিশোর-কিশোরী, তাদের মা–বাবা ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করা হয়েছিল। যে কিশোরীরা ৩৬ থেকে ৪০টি অধিবেশনে (সেশনে) অংশ নিয়েছে, তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহের ঝুঁকি ৪৯ থেকে ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এ কার্যক্রমে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১ হাজার ১২৩ কিশোরীর ওপর জরিপ হয়েছিল। টিপিং পয়েন্ট কর্মসূচির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সচেতনতামূলক আলোচনা, প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যে মেয়েদের জন্য, সেই মেয়েদের বাল্যবিবাহের ঝুঁকি কমেছিল ৫৪ শতাংশ। কিশোরী ও বাবা-মায়েদের অন্তর্ভুক্ত করায় তাঁদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছিল এবং বাল্যবিবাহের ঝুঁকি কমার হার বেড়েছিল। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল কিশোর-কিশোরী, মা–বাবার অধিকারভিত্তিক দলীয় প্রশিক্ষণ, মেয়েদের নেতৃত্বে পরিচালিত এলাকাভিত্তিক কাজে সহায়তা দেওয়া, কিশোর-কিশোরী ও মা–বাবার মধ্যে দলভিত্তিক সংলাপ আয়োজন, কিশোরীদের সংগঠিত করা, সমাজের প্রভাবশালী মানুষ, ধর্মীয় নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ইত্যাদি।
এ গবেষণায় আরও বলা হয়, ‘টিপিং পয়েন্ট’ উদ্যোগটি বাল্যবিবাহ রোধে কিছুটা আশাব্যঞ্জক ফল দেখিয়েছে। করোনার কারণে কার্যক্রম পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই ভালো ফল পেতে ‘টিপিং পয়েন্ট’ কার্যক্রমটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তবে একই ধরনের অন্যান্য উদ্যোগে ৩৬ বা এর বেশি অধিবেশনে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক প্রবণতা পরিবর্তনে সময় লাগে। তাই এ ধরনের উদ্যোগগুলোর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ পর্বে আরও তিনটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিনোদনমূলক শিক্ষা ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সাজানো বিষয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরেন সাজিদা ফাউন্ডেশনের উন্নয়ন কর্মসূচির প্রধান গবেষক মুহাম্মদ নাজমুল ইসলাম। গবেষণায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে টেলিভিশনে প্রচারিত ২৬টি অনুষ্ঠান মূল্যায়ন করা হয়। এতে বলা হয়, বিনোদন কম থাকা, উচ্চ প্রতিযোগিতা, বেশি ব্যয় ও কম দর্শকসংখ্যার কারণে বাল্যবিবাহ নিরোধ অনুষ্ঠান ঘিরে লোকের আগ্রহ কম ছিল। টেলিভিশনের প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের প্রতি মনোযোগ কমিয়েছে।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন কি আচরণ পরিবর্তন করতে পারবে? এ বিষয়ে অনলাইনে অংশ নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরেন মোনাশ ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ।
গৃহস্থালি কাজে বিনা পারিশ্রমিকে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিজের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো মোমো মাকিনো। তিনিও অনলাইনে অংশ নেন।
পর্বটি সঞ্চালনা করেন সাজিদা ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ গবেষণা উপদেষ্টা সাজেদা আমিন।