ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

অভিযোগকারী রাজনীতিবিদদের ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের

বিলুপ্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) করা মামলার অভিযোগকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজনীতিবিদ। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদ ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আইনটির অধীনে ১ হাজার ৪১০টি মামলা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানিয়েছে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।

আজ মঙ্গলবার সিজিএস আয়োজিত ওয়েবিনারে ‘অনন্ত দুর্দশা: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্তদের অবস্থা’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণা দলের প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ গবেষণাটি তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে। আইনটি নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়। জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই আইনে মামলা হয়েছে ৭ হাজার ১টি। গত সেপ্টেম্বরে সরকার ডিএসএ রদ করে সাইবার নিরাপত্তা নামে নতুন একটি আইন করে।

আলী রীয়াজ বলেন, সরকার ডিএসএ আইনে হওয়া মামলার সংখ্যা বাদে আর কোনো তথ্য দেয় না। এই আইন প্রচলনের পর ভয়াবহ অবস্থা দেখা গেছে। দায়ের করা বেশির ভাগ মামলা বিচারাধীন। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আর্থিক, শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পাশাপাশি অনেকে নির্যাতন ও অপহরণেরও শিকার হয়েছেন।

সিজিএস ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিএসএতে করা ১ হাজার ৪১০টি মামলার তথ্য নিয়ে কাজ করেছে। সেগুলোর আসামি ৪ হাজার ৪০৪ জন এবং অভিযুক্ত ১ হাজার ৫১৯ জন। প্রতি মামলায় গড় আসামি ৩ দশমিক ১২ জন।

অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পেশার দিক থেকে রাজনীতিবিদ ৩১ শতাংশ এবং সাংবাদিক ২৯ শতাংশের বেশি। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পেশাগত দিক দিয়ে রাজনীতবিদ সবচেয়ে বেশি। এরপর আছেন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক।

অন্যদিকে পেশাগত দিক দিয়ে ডিএসএতে অভিযোগকারী ৮৪৬ জনের মধ্যে ৩৩৩ জন রাজনীতিবিদ। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদ ২৫৯ জন। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৫২ জন অভিযোগকারী রয়েছেন।

সিজিএসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিএসএতে প্রধানমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৯০টি। এ ছাড়া মন্ত্রীদের মানহানির অভিযোগে ৮০টি এবং রাজনীতিবিদদের মানহানির অভিযোগে ২০৮টি মামলা হয়েছে। ফেসবুকে পোস্ট বা মন্তব্য করার অভিযোগে মামলা হয়েছে ৮৯৪টি এবং মামলাগুলোয় অভিযুক্ত ২ হাজার ২৮৯ জন।

ডিএসএর মামলাগুলো পর্যালোচনা করে সিজিএস বলেছে, বিচারকাজ শুরুর আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিলে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি নিজের স্বার্থে আইনটি ব্যবহার করেছে। ভিন্নমতাদর্শীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার জন্যও আইনটির ব্যবহার হয়েছে। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সীমাহীন দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন।

সরকারের করণীয় হিসেবে আলী রীয়াজ উপস্থাপনায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো ডিএসএ মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা, মামলার তথ্য উন্মুক্ত করা, মামলাগুলোর সত্যতা খুঁজে বের করতে স্বাধীন কমিশন গঠন করা এবং যাঁরা অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, স্বাধীন তদন্ত কমিশন হওয়া জরুরি। নইলে এই দুর্দশা অব্যাহত থাকবে। কারণ, নাম বদল করলেই পরিস্থিতি পাল্টাবে না। পাঁচ বছর ধরে ভিন্নমত দমন, মতপ্রকাশের অধিকারকে সংকুচিত করা এবং ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাশালীদের রক্ষায় আইনটি ব্যবহৃত হয়েছে।

রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকেরা বেশি অভিযুক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে আলী রীয়াজ বলেন, এই দুই শ্রেণি বেশি ভিন্নমত পোষণ করে। তিনি আরও বলেন, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে যেন মানুষ সব সময় ভীত থাকে, একা থাকে। যেকোনো কর্তৃত্ববাদী শাসন টিকে থাকে মানুষকে নিঃসঙ্গ করার মধ্য দিয়ে। তাদের লক্ষ্য, মানুষ যেন সংগঠিত হতে না পারে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ডিএসএ বাতিল হয়ে খুব বেশি উনিশ-বিশ হয়নি। প্রায় সবই একই রকম। দেশের আইনকানুন হয় প্রশাসন-জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য। সরকার বা কোনো সরকারি দলকে রক্ষার জন্য কোনো আইন দেশের মানুষের উপকারে আসে না। সার্বভৌম দেশে তা চলতে পারে না। দেশে সুশাসন গড়ে তুলতে হলে নাগরিক সংগঠনগুলোকে এক হতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, মানুষ এখন ভীত—কোথায় কী বলবে, লাইক দেবে, শেয়ার দেবে, আবার ধরে নিয়ে যাবে। সাইবারজগৎ অনেক ভয়ংকর। এখানকার নিরাপত্তার জন্য আইনের দরকার আছে। কিন্তু যেখানে আইনের প্রয়োগের দরকার, সেখানে কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।

ওয়েবিনারে ডিএসএতে অভিযুক্ত রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের অর্থনৈতিক সমন্বয়ক দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন আর্টিকেল নাইনটিনের জ্যেষ্ঠ প্রোগ্রাম অফিসার রুমকি ফারহানা, রংপুর জজকোর্টের আইনজীবী মো. রায়হান কবীর ও মানবাধিকারকর্মী মো. আবদুল কাইয়ুম।