নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের সবচেয়ে বড় কার্যক্রম হিসেবে ২৪ বছর আগে শুরু হয়েছিল প্রকল্পটি। আজ ৩০ জুন (রোববার) শেষ হচ্ছে দীর্ঘ দুই যুগের এ প্রকল্প। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নেওয়া কার্যক্রমগুলো কি তাহলে বন্ধ হয়ে যাবে?
২০০০ সালে ডেনমার্কের সহায়তায় ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ শিরোনামে এ প্রকল্প শুরু করেছিল মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। দুই বছর আগে ডেনমার্কের সরকারি সংস্থা ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (ডানিডা) প্রকল্প থেকে সরে যায়। এরপর প্রকল্পের ব্যয় কমাতে শুরু করে মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের কর্মীদের ক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে মন্ত্রণালয় প্রকল্পটি চালু রাখে।
নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের চিকিৎসা প্রদান থেকে শুরু করে মামলা পরিচালনা পর্যন্ত সহায়তা দিতে ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), ৬৪ জেলায় ৬৭টি ওসিসি এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে চালু করা ‘হেল্পলাইন ১০৯’–এর মতো কার্যক্রম চলছিল এ প্রকল্পের আওতায়।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁদের কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। তবে তাঁরা অনিশ্চয়তার মধ্যে স্বস্তি পাচ্ছেন না। এক বছর ধরে প্রকল্প নিয়ে টানাপোড়েন ও অর্থসংকটে বেশ কয়েকবার তাঁদের বেতন বকেয়া ছিল। প্রকল্প শেষ হওয়ার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চাকরি হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
আজ প্রকল্পটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। মন্ত্রণালয় নতুন আরেকটি প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যক্রমগুলো চালানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল। তবে নতুন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) এখনো অর্থ বিভাগের জনবল নির্ধারণ কমিটিতে আছে। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় অনুমোদন পাওয়ার পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হতে হবে।
নতুন প্রকল্প পাস হতে ছয় মাসের বেশি লাগবে না। নতুন প্রকল্প প্রস্তাব জুলাই মাসেই পিইসির সভায় তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে কার্যক্রমগুলো যেন বন্ধ না হয়ে যায়, সে কারণে ছয় মাসের বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।প্রকাশ কান্তি চৌধুরী, প্রকল্পের পরিচালক
দীর্ঘ এ প্রক্রিয়ায় নতুন প্রকল্প পাস হওয়ার আগপর্যন্ত অন্তর্বর্তী সময়ে ওসিসি, হেল্পলাইন ১০৯–এর মতো কার্যক্রম চালু রাখতে অর্থ বিভাগের কাছে গত ২৫ এপ্রিল চিঠি দিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চিঠিতে ৬ মাসের জন্য ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে এ অর্থ এখনো ছাড় হয়নি।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন অধিশাখা) এবং সদ্যসমাপ্ত প্রকল্পের পরিচালক প্রকাশ কান্তি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন প্রকল্প পাস হতে ছয় মাসের বেশি লাগবে না। নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব জুলাই মাসেই পিইসির সভায় তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে কার্যক্রমগুলো যেন বন্ধ না হয়ে যায়, সে কারণে ছয় মাসের বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই সপ্তাহে অর্থ বিভাগের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হবে। খুব শিগগির অর্থ ছাড় হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁদের কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। তবে তাঁরা অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনো স্বস্তি পাচ্ছেন না। এক বছর ধরে প্রকল্প নিয়ে টানাপোড়েন ও অর্থসংকটে বেশ কয়েকবার তাঁদের বেতন বকেয়া ছিল। প্রকল্প শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের চাকরি হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অনেকে এ প্রকল্পে ২০ বছর কাজ করেছেন। নতুন কোনো চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাও তাঁদের নেই। নতুন যে প্রকল্প আসছে, সেটিতে তাঁরা স্থান পাবেন কি না, সেটা নিয়েও নিশ্চিত হতে পারছেন না। তাঁদের মূল দাবি ছিল জনবলসহ প্রকল্পটিকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর।
দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় নতুন প্রকল্প পাস হওয়ার আগপর্যন্ত অন্তর্বর্তী সময়ে ওসিসি, হেল্পলাইন ১০৯–এর মতো কার্যক্রম চালু রাখতে অর্থ বিভাগের কাছে গত ২৫ এপ্রিল চিঠি দিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। চিঠিতে ৬ মাসের জন্য ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে এ অর্থ এখনো ছাড় হয়নি।
অবশ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এত দীর্ঘ সময় ধরে কোনো প্রকল্প চলে না। আগে প্রকল্প জনবলসহ রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হতো। ১৯৯৭ সালে সরকারের নির্দেশনায় বলা হয়, প্রকল্পের কার্যক্রম রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হবে, জনবল স্থানান্তর হবে না। রাজস্ব খাতে স্থানান্তর হওয়া কার্যক্রমে নতুন করে জনবল নিতে হবে। এ কারণে এই প্রকল্প দীর্ঘ সময় ধরে চললেও জনবলসহ প্রকল্পের কার্যক্রম রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সুযোগ নেই। তবে শেষ পর্যন্ত পুরোনো প্রকল্পটির আদলে নতুন আরেকটি প্রকল্প নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ সর্বশেষ চতুর্থ পর্বে (২০১৬-২২) বাস্তবায়িত হচ্ছিল। ২০২২ সালে ড্যানিডা প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার পর সরকার এ প্রকল্পকে ‘এ’ থেকে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে নামিয়ে আনে এবং ২৫ শতাংশ বাজেট কমিয়ে ফেলে। এ পর্বে তিন দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) অনুসারে, এ পর্বে মোট ১৩১ কোটি ৯৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল।
প্রকল্পের আওতায় ছিল ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসিসি, ৬৪ জেলায় ৬৭টি ওসিসি সেল, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি, আটটি বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, আটটি আঞ্চলিক ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, হেল্পলাইন ১০৯, মোবাইল অ্যাপ ‘জয়’, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যক্রম এবং নির্যাতন প্রতিরোধে জনসচেতনতা কার্যক্রম। এ ছাড়া ২০২০ সালে গঠন করা হয় পৃথক ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।
১৪টি সরকারি মেডিকেলে স্থাপিত ওসিসিতে ২০০০ থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতন ও যৌন নির্যাতনের শিকার এবং দগ্ধ হয়ে ৬৩ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহায়তা নিয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬৭টি ওসিসি সেলে ১ লাখ ৩১ হাজারের বেশি নারী ও শিশু সহায়তা পেয়েছে। হেল্পলাইন ১০৯–এ ২০২৩ সালে কল এসেছে ৯ লাখ ৪১ হাজারের বেশি।
বাজেট কমে যাওয়ার পর রোহিঙ্গা ও জনসচেতনতা কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। আগে ওসিসিতে সেবা নেওয়া নারীদের সেলাই মেশিন, শিশুদের শিক্ষা উপকরণ এবং মামলার ফলোআপের জন্য ভুক্তভোগীদের মাসে একবার যাতায়াত ভাড়া দিয়ে ডেকে আনা হতো। সেই সহায়তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নতুন প্রকল্পটির নাম হচ্ছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সমন্বিত সেবা জোরদারকরণ’। ৫ বছরের প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত। ৮৬৫ জনবলের প্রস্তাব করা হয়েছে।
যুগ্ম সচিব প্রকাশ কান্তি চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, নতুন প্রকল্পের ব্যয় প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা। পুরোনো প্রকল্পে যে কার্যক্রম রয়েছে, তা আরও বিস্তৃত হবে নতুন প্রকল্পে। আরও ২৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসিসি হবে। ওসিসি সেল বেড়ে হবে ৯৫টি। প্রতিটি জেলার অন্তত একটি উপজেলায় এই সেল থাকবে। নির্যাতনপ্রবণ ও শ্রমিক–অধ্যুষিত এলাকায় সেল করা হবে। এ ছাড়া হেল্পলাইন ১০৯–এ পাঁচজন মনঃসামাজিক কাউন্সেলর নিয়োগসহ জনবল বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি।
পুরোনো প্রকল্পের জনবল নিয়োগ করা হবে কি না, তা জানতে চাইলে প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, পুরোনো জনবল অগ্রাধিকার পাবে। অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার কথা বিবেচনা করে তাঁদের জন্য চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা শিথিল করা হবে।
প্রকাশ কান্তি চৌধুরী জানান, এ প্রকল্পের মতো চট্টগ্রাম বিভাগে রোহিঙ্গা ও বলপূর্বক স্থানচ্যুতির শিকার জনগোষ্ঠীর জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা সহায়তায় মন্ত্রণালয় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করবে। জীবিকা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ২৫ হাজার নারীকে। প্রশিক্ষণের পর ১৮ হাজার নারীকে আয়বর্ধক কাজের জন্য ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে।