সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে জয়নুল উৎসবে ঢাক বাজান শংকর দাস ঢাকি
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে জয়নুল উৎসবে ঢাক বাজান শংকর দাস ঢাকি

ঢাক ও ঢাকিদের কথা 

বাতাসে গাছের পাতার দুলে ওঠা অথবা বয়ে যাওয়া নদীর স্রোত—সবকিছুতেই আছে ছন্দ। সেই ছন্দ অনুভব করে আঙুলে তুলে আনা এক সাধনা। এমন অনুভবের কথাই বললেন বাদ্যযন্ত্রীরা। ফরিদপুর শহরের শ্রীঅঙ্গনের প্রবেশপথের কাছে ‘জগদ্বন্ধু বাদ্য ভান্ডার’। এ দোকানের গৌর কুমার দাস ২৫ বছর ধরে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করছেন। তিনি বলছিলেন, বাংলার বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ঢাক খুবই শক্তিশালী। পূজার আরতি অথবা মঙ্গল শোভাযাত্রায় ঢাকের তাল আনন্দের। 

আবহমান বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ঢাককে যাঁরা পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তাঁরা ঢাকি। সেই ঢাকিরা কেমন আছেন জানতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ঢাকিদের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা বলেন, ঢাকের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা, এই বাদ্যযন্ত্র চারপাশের শব্দ হরণ করে নিজের শব্দকে বিশেষ করে তুলতে পারে।

পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় ২০ বছর ধরে ঢাক বাজাচ্ছেন মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের বাসিন্দা শংকর দাস ঢাকি। ৩৫ বছর ধরে তাঁর একমাত্র পেশা ঢাক বাজানো। ছোটবেলা থেকে বাবা ও ঠাকুরদার বাজানো শুনে ঢাক ভালোবাসতে শিখেছেন তিনি। প্রতিবার ২০ থেকে ৩০ জনের দলের বায়না নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যান তিনি। শংকর বলেন, তাল তৈরি হয়ে যায় হাতের আঙুলে। তবে ঢাকের বোল সুন্দর হয় ঢাকির ভালোবাসায়। ভালো না বাসলে ঢাক ধরে রাখা যায় না।

শোনা যায়, বৈদিক যুগেও ছিল ঢাকের প্রচলন। ঢাক এসেছে ডাক থেকে। এই ডাক হলো উৎসবের। জয় ঢাক ও বীর ঢাকের মতো কয়েক রকম ঢাক আছে। আকৃতির পার্থক্য হিসেবে এর নানারকম নাম। সব ঢাকই কাঠ দিয়ে তৈরি আড়াই থেকে সাড়ে তিন ফুট লম্বা পিপা আকৃতির ফাঁপা খোল। দামি ঢাকগুলো সাধারণত আম কাঠ দিয়েই বানানো হয়। যার দুই দিক আবৃত করা হয় চামড়া দিয়ে। এ জায়গাটিই কাঠির সাহায্যে শব্দের সৃষ্টি করে। বড় আকারের ঢাক ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। ছোট ও মাঝারি আকৃতির ঢাক ছয় হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায় বলে জানান ঢাকিরা।

অনেক ঢাকি আবার নতুন ঢাক ব্যবহারে আগ্রহী নন। উৎসবের সময় তাঁরা পুরোনো ঢাকটি মেরামত করে নেন। যেমন পুরান ঢাকার স্বপন চন্দ্র দাস বাজান প্রায় শতবর্ষী পুরোনো এক ঢাক। তাঁর সঙ্গে কথা হলো রাজধানীর রামকৃষ্ণ মিশনে। ঢাকের বোল তুলতে তুলতে তিনি জানান, এটি তাঁর ঠাকুরদার সময়ের। নিজে বাজাচ্ছেন ৫০ বছর ধরে। তবে উপার্জনের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ম্লান হয়ে গেল এ ঢাকির মুখ। তিনি বলেন, পূজার সময় কিছু আয় হয়। কয়েক দিনের বায়নায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পান। এ ছাড়া সারা বছর অপেক্ষা করতে হয় রাজনৈতিক সমাবেশ বা খুব শৌখিন কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য। তিনি আফসোস করে বলেন, এই বাদ্যযন্ত্র কতকালের পুরোনো, অথচ এখন আর আগের মতো সেভাবে ব্যবহারের চল নেই।

ঢাক যে কতটা পুরোনো ঐতিহ্য, তার এক অনন্য উদাহরণ কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির ঢাকের হাট। প্রথম আলোর কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি তাফসিরুল আজিজ জানান, লোকমুখে প্রচলিত আছে কটিয়াদীর হাটের বয়স প্রায় পাঁচ শ বছর। জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তাঁর রাজপ্রাসাদে পূজার আয়োজন করতেন। তখন থেকে শুরু হয়েছিল এ হাটের।

একটি ঢাকি দলের প্রধান বাগেরহাটের মোল্লাহাটের গণেশ বিশ্বাস। তাঁর দলের যন্ত্রীরা কাঁসরসহ ঢাকের সঙ্গে বাঁশি, ঢোল, সানাই, করতাল, খঞ্জরি এমনকি বিউগলও বাজান। দলের প্রধান জানান, যে যেমন বায়না করেন, তা বুঝে বাদ্যযন্ত্রী নেওয়া হয়। পূজার সময় পাঁচ দিনের জন্য বায়না করা হয়। ১২ সদস্যের সবাইকে নিলে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পান তাঁরা। এই টাকা ভাগ হয় সবার মধ্যে। অন্যান্য অনুষ্ঠানে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এক বা দুই দিনের জন্য যান তাঁরা। তখন সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান।

বায়না না থাকলে বছরের অন্য সময় ফসলের খেতে কাজ করেন গণেশ বিশ্বাস ও দলের অন্যরা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এখন ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়, ফলে বিশেষ উৎসব ছাড়া ঢাকের প্রয়োজন হয় না। একসময় শুধু ঢাকি হিসেবে পেশা টিকিয়ে রাখা যেত। এখন দিন দিন বায়না কমছে, তাই শুধু এ পেশায় টিকে থাকা অসম্ভব।

দেশে ঢাকির সংখ্যা কত, জানা গেল না। কারণ, এই পেশার মানুষদের কোনো সংগঠন নেই।