পদ ও পদোন্নতির দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার এক ঘণ্টার ‘কলমবিরতি’র মাধ্যমে প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামলেন ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আগামীকাল বৃহস্পতিবার মানববন্ধন করার কর্মসূচিও ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।
প্রশাসনের সব পদ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য রাখার দাবিতে গত রোববার সচিবালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বড় জমায়েতের এক দিনের ব্যবধানে কলমবিরতির কর্মসূচি পালিত হলো। অন্যদিকে জনপ্রশাসনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা আজ বুধবার যৌথ সভা ডেকেছেন।
সরকারের উপসচিব পদে কোটাপদ্ধতি বাতিল, নিজ নিজ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ নীতিনির্ধারণী পদে দায়িত্ব দেওয়া এবং সব ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমান অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে গতকাল কলমবিরতি পালন করেছে ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’।
পরিষদভুক্ত কর্মকর্তারা গতকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নিজ নিজ দপ্তরের সামনে কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করেন। দাবি আদায় না হলে আগামী ৪ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিষদের সমন্বয়ক মোহাম্মদ মফিজুর রহমান।
পদোন্নতি, পদায়নসহ বেশ কিছু দাবিতে গত ১ সেপ্টেম্বর আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ নামে এই জোট গঠিত হয়। জোট গঠনের পর থেকে নিজেদের বিভিন্ন দাবিতে সোচ্চার হয় এই সংগঠন।
এরই মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্যান্য ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা রাখার সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আলোচনায় আসে। একই সঙ্গে কমিশন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারভুক্ত না রেখে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো আলাদা করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে। এ বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে আন্তক্যাডার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। এমন সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতির কোটা কমে যাবে বলে তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
গতকাল আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন দপ্তরে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা কলমবিরতি পালন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ডাক, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য, পরিসংখ্যান, রেলওয়ে, কৃষি, সমবায়সহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তাঁরা কার্যালয়ের ভেতর ও বাইরে ব্যানার টানিয়ে কর্মসূচি পালন করেন।
গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনের সামনে দেখা যায়, বিসিএস (পরিসংখ্যান) ক্যাডারের কর্মকর্তারা ভবনের সামনে কলমবিরতি পালন করছেন। এ সময় কর্মকর্তারা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
বিসিএস পরিসংখ্যান ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা গাড়ি-সুবিধা পান। গাড়ি সংরক্ষণে মাসে ৫০ হাজার টাকা করে পান। অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা এসব সুবিধা পান না। কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা সমান করতে হবে।
বেলা সাড়ে ১১টায় আগারগাঁওয়ে বেতার ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিসিএস (তথ্য) প্রকৌশল বেতার কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি, বিসিএস (তথ্য) সাধারণ বেতার কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির ব্যানারে কর্মবিরতি পালন করা হচ্ছে। তাঁদেরও দাবি, উপসচিব পদে কোনো কোটা থাকবে না।
২৫ ক্যাডারের মধ্যে কর্মকর্তার সংখ্যার দিক দিয়ে বড় ক্যাডার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার। এই দুই ক্যাডারে কর্মকর্তা রয়েছেন যথাক্রমে প্রায় ১৬ হাজার ও ৩০ হাজারের বেশি। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তাঁদের ক্যাডারভুক্ত না রাখার যে সুপারিশের কথা বলছে, তার প্রতিবাদে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার আলাদা কর্মসূচি পালন করছে। স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন গত সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের দাবি তুলে ধরেছে। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী পদে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন এবং উপসচিব পদে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের ১৫ দফা দাবির কথা তুলে ধরল শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, বিসিএস সাধারণ শিক্ষাকে ক্যাডারের বাইরে রাখার পরিকল্পনা থেকে সরে আসা, কোটা তুলে দিয়ে সরকারের উপসচিব পদে পরীক্ষার মাধ্যমে সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সমান সুযোগ দেওয়া ইত্যাদি। দাবি না মানলে ৩১ ডিসেম্বর পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তাজিব উদ্দিন।
লিখিত বক্তব্য বলা হয়, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারকে ক্যাডার–বহির্ভূত করার অশুভ প্রচেষ্টা প্রতিরোধ এবং শিক্ষা ক্যাডারের ১৫ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সবার প্রত্যাশা ছিল জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রের নাগরিকদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার জন্য সিভিল সার্ভিসের ২৬ ক্যাডারের মধ্যে বিরাজমান আন্তক্যাডার বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের বেসামরিক প্রশাসনকে আরও গতিশীল ও যুগোপযোগী করার জন্য দিকনির্দেশনা দেবে। তাদের বিশ্বাস ছিল, এবার হয়তো ৪০ বছর ধরে জমে থাকা সংকটগুলো থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ পাবে শিক্ষা ক্যাডার। কিন্তু জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সম্প্রতি তাঁদের সুপারিশে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে বাইরে রাখার যে পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেছেন, তা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৬ হাজার কর্মকর্তাকে তীব্রভাবে আহত করেছে এবং উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যেও ফেলে দিয়েছে। এ জন্য তাঁরা এই পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করছেন।
‘জনপ্রশাসনের সংস্কারকে ভিন্ন খাতে পরিচালিত করে দেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্রের’ বিরুদ্ধে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা আজ যৌথ সভা ডেকেছেন। রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে আজ সকালে এ সভা হবে বলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে।