সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি: বিচারালয়কে যেন কোনোভাবে রাজনীতিকরণ করা না হয়

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান
ফাইল ছবি: বাসস

দুর্নীতিমুক্ত বিচারব্যবস্থা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। একই সঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তিনি চান, বিচার বিভাগ ও বিচারালয়কে যেন কোনোভাবে রাজনীতিকরণ করা না হয়।

আজ রোববার সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ১ নম্বর বিচারকক্ষে (প্রধান বিচারপতির এজলাস) অনুষ্ঠিত সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এসব কথা বলেন।

সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের বিচারব্যবস্থাকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে এবং সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য করতে একটি দীর্ঘমেয়াদি জুডিশিয়াল প্ল্যান তৈরি করতে চাই।’

দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে গত ২৬ সেপ্টেম্বর শপথ নেন ওবায়দুল হাসান। তখন সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ চলছিল। অবকাশ শেষে আজ আদালত খুলেছে। এর আগে গত ১২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।

রীতি অনুসারে আজ প্রধান বিচারপতিকে বিচারকক্ষে সংবর্ধনা জানানো হয়। সংবর্ধনায় প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রধান বিচারপতির কর্মময় জীবন নিয়ে বক্তব্য দেন। পরে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির।

যেন কোনোভাবে রাজনীতিকরণ করা না হয়

সংবর্ধনায় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমি চাইব, বিচার বিভাগ ও বিচারালয়কে যেন কোনোভাবে রাজনীতিকরণ করা না হয়।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখানে বিচারক ও আইনজীবীদের সম্মিলিত ও মেধাপুষ্ট দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই কেবল সুবিচারের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে; তবেই বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকবে। আমাদের সুপ্রিম কোর্টের এই বিচার অঙ্গন পারস্পরিক সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসায় আলোকিত হোক, এটিই আমার প্রত্যাশা। একটি কথা একটু অপ্রিয় হলেও বলতে চাই, কোনো বিষয়ে ভালোভাবে না জেনে বা যথেচ্ছভাবে বিচারক ও আদালত সম্পর্কে কটু মন্তব্য মোটেই সভ্যতার ইঙ্গিত বহন করে না।’

বিচারকের রায়ের সমালোচনা করার অধিকার বাক্স্বাধীনতার একটি অংশ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সংবিধানে এই বাক্স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।...তবে কেউ যদি স্বাধীনতার অপব্যবহার করে, তা সংবাদমাধ্যমই হোক, আইনজীবীই হোক বা যে কেউ হোক, তাকে শায়েস্তা করার জন্য আদালতের হাত যথেষ্টই লম্বা।’

সংবাদ পরিবেশনে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবেন

সংবাদপত্র দেশের সমাজব্যবস্থার প্রতিবিম্ব বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার যেসব সাংবাদিক এই অঙ্গনে কাজ করেন, তাঁদের বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে দেশের সাধারণ নাগরিকেরা বিচারাঙ্গন সম্বন্ধে ধারণা পেয়ে থাকেন। যেহেতু বিচারকেরা সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হয়ে কোনো বক্তব্য প্রদান করতে পারেন না, তাই সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি তাঁর অনুরোধ থাকবে, আদালত বা বিচারক–সম্পর্কিত কোনো সংবাদ পরিবেশনে তাঁরা যেন যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেন।

অধস্তন আদালত বিচার বিভাগের ‘প্রেস্টিজ পয়েন্ট’

অধস্তন আদালতগুলো বিচার বিভাগের ‘প্রেস্টিজ পয়েন্ট’ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা আপনাদের সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অসহায় মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ যেন নিশ্চিত হয়, সেদিকে দৃষ্টি রেখে দায়িত্ব পালন করবেন।...অধস্তন আদালতগুলোকে আমি বিচার বিভাগের প্রেস্টিজ পয়েন্ট বলে মনে করি। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে বিচারক হিসেবে আমাদের সকলের সুনাম সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে অধস্তন আদালতের ওপর। কেননা, প্রাত্যহিক কাজে সবচেয়ে প্রান্তিক জায়গা থেকে একজন বিচারপ্রার্থী শুরুতেই যে আদালতের দ্বারস্থ হন, সেটি হলো জেলা পর্যায়ের কোনো আদালত। তাই জেলা পর্যায়ের আদালতসমূহে আমার যে সহকর্মী বিচারকবৃন্দ কর্মরত আছেন, তাঁদের বলব, তাঁরা যেন কখনোই সময়ের অপচয় না করে অহর্নিশি বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে কাজ করেন। এ জন্য বিরতিহীন জ্ঞানচর্চার মধ্য দিয়ে নিজেদের মেধা ও দক্ষতাকে শাণিত করতে হবে। বারের বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দ, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ ও বিচারপ্রার্থী জনগণের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।’

বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আরও বলেন, ‘স্মরণ রাখতে হবে যে বিচারকের চরিত্রের সঙ্গে অহেতুক তাড়াহুড়া, হঠাৎ ধৈর্য হারানো, আইনজীবীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, আদেশ ও রায় লেখার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি আচরণ কখনোই যায় না। তাই সচেতনভাবে এসব পরিহার করে চলতে হবে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের অসুবিধাগুলা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। এগুলো দূরীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমি সচেষ্ট হব।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি অবগত আছি যে অধস্তন আদালতের আমার সহকর্মী বিচারকদের পর্যাপ্ত জনবলের অভাব থেকে শুরু করে অনেক ধরনের ভৌত-অভৌত সীমাবদ্ধতার মধ্যে দায়িত্ব পালন করতে হয়। অতীতের মতোই নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে আমরা ধাপে ধাপে এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠব।’

আইনজীবীদের সার্বিক সহায়তাই কেবল একজন বিচারকের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। এ ছাড়া বিচারকদের দায়িত্ব পালনের প্রতি সব সময় সহায়তামূলক সাহায্যের মনোভাব অক্ষুণ্ন রাখতে বারের সদস্যদের ও অন্যদের প্রতি আহ্বান জানান ওবায়দুল হাসান।

মামলাজট প্রকারান্তরে সুবিচারের ধারণাকে বিনষ্ট করে

মামলাজট ও বিলম্বিত বিচার প্রকারান্তরে সুবিচারের ধারণাকে বিনষ্ট করে বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বলেন, ‘কীভাবে এটি থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করা যায়, সেই কার্যকর পথ ও প্রক্রিয়া বের করতে হবে। একই সঙ্গে এটিও বলি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের সকল স্টেট মেশিনারিজেরও দায়িত্ব রয়েছে। মনে রাখতে হবে, স্বাধীন বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সুশাসনের ধারণাটি সম্পৃক্ত। মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের মূল উপাদান হলো স্বাধীন ও কার্যকর বিচারব্যবস্থা, যা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।’

সাক্ষী ও ভিকটিমদের সুরক্ষায় আইন হয়নি

সাক্ষী ও ভিকটিমদের সুরক্ষার জন্য দেশে এখন পর্যন্ত কোনো আইন প্রণীত হয়নি বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাব ও ভীতিতে আক্রান্ত সাক্ষীরা সমন জারি সত্ত্বেও আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসে না। এলেও ভয়ে সাক্ষীরা আদালতে সত্য গোপন করে। ফলে মামলার বিচার প্রলম্বিত হয়। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, স্থানীয় প্রতাপ-প্রভাবের কারণে এমনটি হয়। অনেক সময়ই সাক্ষীর হাজিরা নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট বিচারকের কলম কার্যকরভাবে সচল হয় না, বছরের পর বছর প্রলম্বিত হয় বিচার। সাক্ষীরা হয়ে পড়ে অনাগ্রহী। এসব অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। এ জন্য সকলের সক্রিয় ভূমিকা অনিবার্য।’

সংবর্ধনায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর–উল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ ও ফিদা এম কামাল উপস্থিতি ছিলেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা, আইনজীবীসহ অন্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি পরিপূর্ণ ছিল। অনুষ্ঠানে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বিএনপিপন্থী আইনজীবী নেতাদের দেখা যায়নি।

অন্যদিকে, এই সংবর্ধনায় যোগ না দিয়ে বিএনপিপন্থী ও সমমনা আইনজীবীদের মোর্চা ইউনাইটেড ল ইয়ার্স ফ্রন্ট সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে।