গতকাল বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার পূর্বাভাস ছিল ১৪ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। রাত নয়টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১১ হাজার ৭৪২ মেগাওয়াট।
জ্বালানি সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের রুটিন (সময়সূচি) মানতে পারেনি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় রুটিনের (সূচি) বাইরেও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার ছিল সরকারের পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের প্রথম দিন। এ দিন ঢাকায় কোথাও কোথাও দুই থেকে তিন ঘণ্টা, আর ঢাকার বাইরে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে।
দেশের ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। তাঁরা বলেছেন, রাজধানীর দুটি বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকো গতকাল দিনে সর্বোচ্চ ৩০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ ঘাটতি পেয়েছে। কোনো এলাকায় এক ঘণ্টা দিলেও অন্য এলাকায় একটু বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে তাদের। ফিডার (একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের আওতাধীন এলাকা) ধরে লোডশেডিংয়ের রুটিন করা হলেও তা মানতে পারছে না ডিপিডিসি ও ডেসকো।
ঢাকার মিরপুরের বর্ধিত রূপনগর (কালাপানি ফিডার) এলাকার গ্রাহক জাফর সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, রুটিন অনুসারে রাত আটটা থেকে নয়টা পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার কথা। অথচ ভোর ছয়টা থেকে সকাল সাতটা, বেলা সোয়া দুইটা থেকে সাড়ে তিনটা ও সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা থেকে রাত আটটা—তিনবার লোডশেডিং হয়েছে তাঁর এলাকায়।
রুটিনে কিছুটা ব্যত্যয় হয়েছে বলে স্বীকারও করেছেন ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান ও ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির কাওসার আলী। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ কম পাওয়ায় রুটিনের বাইরেও করতে হয়েছে। রাত আটটায় এ দুটি বিতরণ কোম্পানির আলাদা দল নজরদারি করে বিপণিবিতান বন্ধ করেছে। প্রতিদিন লোডশেডিংয়ের নতুন রুটিন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে তারা।
গতকালের সারা দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্য জানা যাবে আজ বুধবার। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পূর্বাভাস বলছে, গতকাল দিনে সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ১৪ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। একই সময়ে ১২ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট উৎপাদন হওয়ার কথা। এতে ঘাটতি হতে পারে ১ হাজার ৯১৮ মেগাওয়াট। যদিও পিডিবির একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৭৪২ মেগাওয়াট।
এক ঘণ্টা লোডশেডিং করে এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয় ৯৭৬ মেগাওয়াট। অবশ্য প্রকৃত চাহিদা আরও বেশি বলে লোডশেডিং বাড়ছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য সরকারি নির্দেশনা মেনে রাত আটটার পর রাজধানীর দোকানপাট ও বিপণিবিতানগুলো বন্ধ হচ্ছে। তবে নিয়ম মেনে বন্ধ করলেও অনেক দোকানমালিক বলেছেন, বন্ধের সময়সীমা আরও এক ঘণ্টা বাড়ালে তাঁদের ব্যবসার ক্ষতি কম হতো। গতকাল রাতে রাজধানীর একাধিক বিপণিবিতান ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে দেশের বৃহত্তর বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। অনেক এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে তাদের। এতে ঢাকার বাইরের গ্রাহকের ভোগান্তি হচ্ছে বেশি।
দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আরইবি। ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মধ্যে বাকি পাঁচটি লোডশেডিংয়ের রুটিন প্রকাশ করলেও কেন্দ্রীয়ভাবে তা জানায়নি আরইবি। তবে সংস্থাটির অধীনে থাকা ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কোনো কোনোটি নিজ নিজ এলাকায় লোডশেডিংয়ের রুটিন প্রকাশ করেছে। সংস্থাটির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের অধীনে থাকা সব সমিতির কাছ থেকে এ রুটিন চাওয়া হয়েছে। আজ এটি প্রকাশ করা হতে পারে।
তবে কয়েক দিন ধরেই কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে আরইবি। প্রতিদিন তাদের ঘাটতি বাড়ছে। গত সোমবার তাদের সর্বোচ্চ ঘাটতি ছিল ৫৯৮ মেগাওয়াট। এই দিন রাত ১২টার পরই ঘাটতি ছাড়িয়ে যায় ৮০০ মেগাওয়াট। গতকাল সকাল থেকে এটি আরও বাড়তে থাকে। বিকেলে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। আরইবির কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকার আশপাশে, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোসহ ৩০ থেকে ৩৫টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি খুবই নাজেহাল অবস্থায় আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।
ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরেই লোডশেডিংয়ের রুটিন না মানার ঘটনা বেশি ঘটছে। রংপুরে এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের পর বিদ্যুৎ এলেও আবার আধা ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। গতকাল শহরের মুন্সিপাড়া ফিডারের আওতাধীন প্রায় ১২টি এলাকায় বিকেল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত লোডশেডিং হওয়ার কথা ছিল। তবে সকাল থেকেই ওই এলাকাগুলোতে কয়েক দফা লোডশেডিং হয়েছে।
সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত শহরের কাছারি বাজার ও এর আশপাশের এলাকায় চারবার লোডশেডিং হয়েছে। এ সময় ১০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং স্থায়ী হয়েছে। ওই অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানি নেসকোর রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রংপুর বিভাগের আট জেলায় বিদ্যুতের গড় চাহিদা ৯০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ৪৫০ মেগাওয়াট। এলাকাভেদে লোডশেডিংয়ের তালিকা রক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
নওগাঁ পল্লী সমিতি-১ ও সমিতি-২-এর অধীনে জেলার অধিকাংশ এলাকায় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে গতকাল। তবে নওগাঁ পৌরসভাসহ শহর এলাকায় নিয়ম মেনে লোডশেডিং করা হয়েছে। নওগাঁ জেলায় আরইবির ৭ লাখ ৮৫ হাজার গ্রাহকের জন্য সর্বোচ্চ ১৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ মেগাওয়াট।
লোডশেডিংয়ের কারণে আমন ধান চাষ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নওগাঁর কৃষকেরা। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) বিদ্যুৎ চালিত গভীর নলকূপগুলো (ডিপ টিউবওয়েল) বন্ধ থাকায় জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। নওগাঁ পল্লী সমিতি-১-এর মহাব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম বলেন, লোডশেডিংয়ের রুটিন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিন থেকে চার ঘণ্টা করে লোডশেডিং হয়েছে বিভিন্ন ফিডারে। তবে বরিশাল বিভাগের পাঁচ জেলায় লোডশেডিং করতে হয়নি। এ অঞ্চলে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে স্থানীয় পর্যায়ে।
পিডিবি বলছে, গরমে বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিদিন বাড়ছে। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ সাশ্রয়ে ১ হাজার ২৯০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১০টি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব কটি বন্ধ রাখা হয়েছে। খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিও বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এতে বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের চাহিদার চেয়ে কম সরবরাহ পাচ্ছে। আষাঢ় শেষে শ্রাবণ শুরু হয়ে গেছে। অথচ প্রতিদিন তাপমাত্রা বাড়ছে। বৃষ্টি শুরু না হলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে না। এতে লোডশেডিং বাড়তে পারে।
তবে সরকারিভাবে বলা হয়েছে, এক ঘণ্টায় কাজ না হলে এক সপ্তাহ পর দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং করা হবে। এ ছাড়া চাহিদা কমাতে সরকারি অফিস দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিত লোডশেডিং বাস্তবায়নে সরকারের সক্ষমতার ঘাটতি আছে। প্রতিশ্রুতি অনুসারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলে বিতরণ কোম্পানিগুলো রুটিন মেনে লোডশেডিং দিতে পারবে না। এতে প্রান্তিক মানুষকেই বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হবে।